December 23, 2024, 8:21 am

মারিয়ার কাছে যে আন্তরিকতা পেয়েছি সারাজীবন মনে থাকবে

Reporter Name
  • Update Time : Friday, May 29, 2020,
  • 377 Time View

রুমানিয়া নামে পূর্ব ইউরোপের একটা দেশ আছে। এই দেশের নামের সাথে ছোটবেলায় পরিচিত হই বিশ্বের সেরা জিমন্যাস্টিকস নাদিয়া এলেনা কোমানেসিকোর নাম শুনে। তার কারণে শৈশবে রুমানিয়ার প্রতি একটা ভাললাগা জন্মেছিল। বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার পর আধুনিক রুমানিয়ার জনক নিকোলাস চসেস্কুর সাথে পরিচয়।

নব্বই দশকে রুমানিয়ার সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর চসেস্কুর নির্মম মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছিল। তখন মনে মনে ভেবেছিলাম কোনদিন বুখারেস্ট গেলে চসেস্কুর স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবো। রুমানিয়া আমি ঠিকই গিয়েছি কিন্তু তার সমাধিস্থলে যেতে পারিনি।

রুমানিয়া যাবার সুযোগ হয়েছিল ২০০৯ সালে। সেই সময় আমি এন্ড্রু গাডেসের আমন্ত্রনে জার্মান এসেছিলাম ইউরোশিয়া ইন্সটিটিউট ভিজিটে। বার্লিনে আমার তিনদিনের নির্ধারিত প্রোগ্রাম শেষ করে রুমানিয়া গিয়েছিলাম। রাজধানী বুখারেস্টের ওল্ডটাউনে ছিলাম তিনরাত চারদিন।

ইইউভুক্ত দেশ না হওয়ায় আমার সেনজেন ভিসার সাথে বার্লিন থেকে রুমানিয়ার ভিসা সংগ্রহ করতে হয়েছিল ৬০ ইউরো দিয়ে। বাংলাদেশে রুমানিয়ার কোন দূতাবাস না থাকায় ভিসা নিতে হয় নয়াদিল্লি থেকে।

জেটএয়ারে বার্লিন থেকে রুমানিয়া যেতে সময় লেগেছিল আড়াইঘণ্টা। বুখারেস্ট এয়ারপোর্টটি শহরের বাহিরে অটোপেনিতে। দুপুর দুইটায় এয়ারপোর্টে নেমে ইয়োলো ট্যাক্সি চেপে সোজা হোটেল “ওল্ড সেন্টারুম বুখারেস্টে।” পূর্ব থেকে বুকিং দেয়ায় খুব সস্তায় মাঝারি মানের এই হোটেলে রুম পেয়েছিলাম মাত্র ৩০ ইউরোতে।

ট্যাক্সিতে বুখারেস্ট ওল্ডটাউন যেতে যেতে চোখে পড়ে ছোট বড় অসংখ্য বিল্ডিং। সাদা ও ধূসর ব্লকের। এসব ভবনের গঠন রুশ স্থাপত্যশৈলীর , যা কমিউনিস্ট শাসনামলকে স্মরণ করিয়ে দেয়। বেশকিছু রুমানিয়ান সিনেমায় এই ধরনের ভবন দেখেছি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এগুলির ব্যাপক পরিবর্তন করা হয়েছে। ভবনগুলোতে রং চংয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। চলতি পথে সামান্য দেখায় বুখারেস্টকে আমার খুব সুন্দর পরিপাটি শহর মনে হলো না ।

শহরে ঢোকার মুখে বিশাল গেইট। অনেকটা প্যারিসের আর্ক ডি ট্রায়ামফের অবিকল কপি। রাস্তাঘাট বেশ চওড়া। দু’পাশে অসংখ্য গাছ। সবুজ আর সবুজে মোড়ানো। শহরের মাঝে এই সবুজাভ মন ভরিয়ে দেয়।

হোটেলে ঢুকে লম্বা শাওয়ার নিয়ে সোজা দৌড় রুফটপ রেস্টুরেন্টে। ক্ষুধায় পেট শুধু নয়, মাথা ভারি হয়ে আছে। কিন্ত লাঞ্চ করতে এসে খাবারের তেমন কিছুই পেলাম না। ম্যানেজার জানালো, ওদের এখানে লাঞ্চ শুরু হয় বেলা বারোটায়। দুপুর দুইটায় অলমোস্ট লাঞ্চ শেষ হয়ে যায়। আর আমি লাঞ্চের জন্য এসেছি বেলা সাড়ে তিনটায়।

তারপরও ম্যানেজারকে বলি, কিছু একটা দাও। পেটের আগুন নেভাতে হলে জল ঢালতে হবে।

কিচেন থেকে ঘুরে এসে ম্যানেজার দুঃখি দুঃখি চেহারা নিয়ে জানায়, আমি খুবই দুঃখিত। তোমার জন্য লাঞ্চের কিছুই নেই। একটু সময় দিলে কিছু একটা খাবার দিতে পারি। ব্রেড, বাটার, চিকেন সসেস, সালাদ দেয়া যাবে। কি আর করা, আপাতত ক্ষুধা মেটানো প্রয়োজন। মাথা নেড়ে জানাই, তাই দাও ।

দুপুরে খাবার পর আমার ঘুমানোর বদাভ্যাস। ব্রেড, চিকেন সসেস ও সালাদ খেয়ে রুমে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে ঘুমিয়ে পড়ি। সেই ঘুম ভাংগলো সন্ধ্যাবেলা।

২.
হোটেল থেকে ভর সন্ধ্যা বেলায় হাঁটতে বের হই। আমার হোটেলটি ওল্ডটাউনে। সেন্ট্রাল বাস ও রেলস্টেশন খুব কাছেই। হাঁটাপথে মিনিট দশ পনেরো লাগে।

বুখারেস্ট শহরের যানবাহন ব্যবস্থা খারাপ না৷ পাবলিক বাস, ট্রাম, রেল আছে ৷ ঝকঝকে প্রাইভেট গাড়ির পাশাপাশি পুরানো আমলের ভক্সওয়াগন গাড়িও চোখে পড়ে। বোঝা যায় নব্বই দশকে চসেস্কুর পতন ও সমাজতন্ত্রের বিদায়ের পর একদল নব্য ধনীর হাতে প্রচুর অর্থ চলে আসে। এরা রাতারাতি পুঁজিপতি বনে যান। সেই সময় তাদের হাতে রুমানিয়ার অর্ধেক সম্পদ চলে যায়। তারাই ঝকঝকে গাড়ি, আধুনিক স্থাপত্যের ফ্ল্যাট, বিশাল ভিলা, বিলাসবহুল বাড়ির মালিক বনে গেছেন।

এদের সমর্থনপুষ্ট বর্তমান পুঁজিবাদী সরকার বেকারত্ব দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসনের অন্দরে দুর্নীতি ছেঁয়ে গেছে। সমাজতন্ত্রের উত্থানের ভয়ে এরা চসেস্কুর নাম নিশানা মুছে ফেলেছে। তার সমাধিস্থলে কোন বিদেশীকে প্রবেশ করতে পর্যন্ত দেয় না। ওদের ভয় বেঁচে থাকা চসেস্কুর চেয়ে মৃত চসেস্কু অনেকবেশী শক্তিশালী।

সেপ্টেম্বর মাসে এসেছি বলে ভয়ে ছিলাম আবহাওয়া কি রকম হবে ভেবে। পাতলা উইন্ডব্রেকার জ্যাকেট পড়ে রুম হতে বের হয়েছি। রাতের বেলা খুব একটা গরম নেই ৷ দিনের বেলায় তাপমাত্রা খুব নীচে না নামলেও বিকেলের পর থেকেই বেশ ঠাণ্ডা লাগে।
সারা বছরের গড় তাপমাত্রা ৭ .৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ওল্ডটাউনে হাঁটতে হাঁটতে রুমানিয়ানদের লক্ষ্য করি। পর্যটকদের দেখে হাই বা হ্যালো করা এবং সাধারণ মানুষের আতিথেয়তা, বন্ধুবাৎসলতা আর আন্তরিকতা সহজেই মুগ্ধ করে। তাই এদের জীবন যাত্রা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার আগ্রহটা বেড়ে যায়। কোন দেশে গেলে আমি সর্বপ্রথম রেস্টুরেন্ট, পাব, বারে ঢুকে এসব জানার জন্য মানুষের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করি। এর ব্যতিক্রম হলো না বুখারেস্টেও।

ওল্ডটাউনের একটা পাবে বসে বিয়ারের বড় গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দেখি আশেপাশের মানুষগুলো হৈ চৈ করে বিয়ার খাচ্ছে। উচ্চস্বরে কথা বলছে। বেজায় স্ফুর্তিবাজ মনে হলো। যা আমি এখানে আসার আগে বার্লিনে পাইনি।

পাবে পরিচয় হয় মারিয়াস্কুর সাথে। ত্রিশ ছুঁই ছুঁই এই নারী বুখারেস্টে এক হাসপাতালে জব করতেন। মাস তিনেক আগে তাঁর চাকুরি চলে যায়। বুখারেস্ট থেকে ৪০ কিলোমিটার দুরের শহর ব্রাসাভায় তাঁর জন্ম ও বেড়ে উঠা। চাকুরির জন্য তাঁর বুখারেস্ট থাকা। বিয়ারের সোনালী পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে নানান বিষয়ে গল্প হয়। রাজনীতি, সিনেমা, খেলা এই তিন বিষয়ে আমার মতন তার সমান আগ্রহ। তাই আমাদের আড্ডা দারুন জমে উঠে। জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমেনিচি, কমিউনিস্ট নেতা চসেস্কু থেকে ফুটবলার হ্যাজি কি ছিল না আমাদের আড্ডার বিষয়ে!

রাত সাড়ে এগারোটায় বিদায় নেয়ার সময় মারিয়াকে বলি, যদি তুমি ফ্রি থাকো আগামী দুইদিন আমাকে শহর দেখাতে পারো। আমি অবশ্যই তোমাকে নিরাশ করবো না।

ইটস এ গ্রেট অপরচুনিটি এন্ড ফিল অনারড।

হোপ ইউ উইল জয়েন উইথ মি ফর ব্রেকফাস্ট। দ্যান উই হ্যাভ টু গো আউট সাইড।
শিওর। আই উইল কাম। মারিয়াক

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71