আমরা উন্নয়নের নামে একটা অন্যায্য সমাজ নির্মাণ করেছি। যেখানে ন্যায্যতা নেই, সেখানে হৃদয় নেই।বাংলাদেশের সামনে কোভিড -১৯ পড়া মাত্রই প্রমাণ হয়ে গেল, কী ঠুনকো এই দেশের উন্নয়ন! কী ভঙ্গুর এই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা!
স্বাভাবিক সময়ে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলেই স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। সে কারণেই সাধ্যাতীত ব্যয় হলেও মানুষ ছোটে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা খাতে ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায় ৬৬ লাখ মানুষ। অথচ স্বাস্থ্য সেবা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি। বারবার বলা সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়ে কখনোই মনযোগী হয়নি। কারণ সরকারের মন্ত্রী এমপি এবং প্রভাবশালী বিত্তবানদের সর্দি লাগলেও তাদের ছিল ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন কিংবা আমেরিকা।
কোভিড-১৯ এর কথা চীন অফিসিয়ালি ঘোষণা করে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯। আর বাংলাদেশে এর সরকারি স্বীকৃতি মেলে ৮ মার্চ ২০২০। সরকারি হিসাব মতেই সরকার সময় পেয়েছিলেন ২ মাস ৮ দিন। এতটা সময় পাওয়ার পরও এই ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো? দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কেবল একটিতে দু’টি থার্মাল স্ক্যানার ছিল, যার একটি আবার অল্প দিন পরেই বিকল হয়ে যায়, আর স্থলবন্দর সবগুলোই ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে এসেছে সাড়ে ছয় লাখ প্রবাসী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এসেছে করোনা আক্রান্ত দেশগুলো থেকে। অথচ কোয়ারেন্টাইনে আছে মাত্র কয়েক হাজার। বাকি ৬ লাখ মানুষের হদিস জানতে এবং ব্যবস্থা নিতে কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। তারা বাজারে গেছেন, জমায়েত হয়েছেন, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা করেছেন, মসজিদে গেছেন, করেছেন আরও অনেক কিছু, যার দ্বারা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ১৬ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের খুব সাধারণ একটি বার্তা, তা হলো– পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা। সব দেশেরই উচিত সন্দেহজনক সব রোগীকে পরীক্ষা করা। চোখ বন্ধ করে থাকলে দেশগুলো এই মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না’। তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষা ছাড়া সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করা যাবে না, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না’। যেখানে সন্দেহভাজন রোগীকে শনাক্ত করতেও পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে করোনা উপসর্গ নিয়ে মরে যাওয়ার পরও কোন কোন ক্ষেত্রে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই!
কোভিড-১৯ সংক্রমিত সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসায় কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র বা ভেন্টিলেটর ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু করোনার চিকিৎসায় এই সুবিধা আছে শুধু ঢাকাতে, বাকি ৬৩ জেলায় কোনও ভেন্টিলেশন সুবিধা নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র মতে, করোনা মোকাবিলায় সারা দেশে ৪৫১৫টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত করা হয়েছে, এরমধ্যে শুধু ঢাকাতেই করা হয়েছে ১০৫০টি। দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেড আছে ২২১টি, যার অনেকগুলোতেই ভেন্টিলেটর নেই। কোভিড ডেডিকেটেড একটা হাসপাতালেও সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই।
পৃথিবীর নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স-এর মতে, বিশ্বে অতি ধনী (যাদের সম্পদের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার ওপরে) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম, ধনী (যাদের সম্পদের পরিমাণ ৮.৫ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকা) বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয়। অথচ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। এই অভূতপূর্ব বৈষম্যই ব্যাখ্যা দেয় মাথাপিছু
আয় বৃদ্ধির, ব্যাখ্যা দেয় সরকারের দাবিকৃত ‘উন্নয়ন’এর । বরং দিনশেষে শুভংকরের ফাঁকিটাই চোখে পড়ে।
মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। শবযাত্রায় যুক্ত হচ্ছে নতুন লাশ। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে ভাইরাসটিতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬১০ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৭৬৪ জন। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে ৪৪ হাজার ৬০৮।
এক অপরিকল্পিত, লোভী, দুর্নীতিবান্ধব উন্নয়ননীতির খপ্পরে পড়েছে দেশ। ঘটনা, দুর্ঘটনা, রোগব্যাধির মহামারি চলছে। জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব ও সমবণ্টনের উন্নয়ননীতি কোথাও নেই। প্রশাসন আইনের প্রয়োগ করতে অনেকটাই ব্যর্থ। তথাকথিত এই উন্নয়নের ফল ভোগ করছে কেবল সমাজের অভিজাতরাই। মাঝেমধ্যে যারা ছিটাফোঁটা ভাগ পাচ্ছে, তারাও অভিজাতে পরিণত হচ্ছে। মধ্যবিত্তের অবস্থা খুবই করুণ। মধ্য ও নিম্নবিত্ত বেঘোরে মারা পড়ছে পথেঘাটে, নদীতে, ভবনে। জীবনের দাম লাশ হওয়ার পর কয়েক লাখ টাকায় নেমে এসেছে। একটি দুর্ঘটনামত্ত, রোগব্যাধিগ্রস্ত ও অপরাধী সমাজের বিকাশ ঘটছে।
দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, এর লাভ কি, যদি জীবনেরই নিরাপত্তা না থাকে। যে জীবন পুড়ে যাওয়ার, গাড়িচাপা পড়ার, উন্নয়নের ফল ভোগ করার আগেই অপঘাতে ফুরিয়ে যাওয়ার, সে জীবনের মূল্য কোথায়? প্রশ্ন হচ্ছে, কিসের জন্য এত উন্নয়ন, কার জন্য এই উন্নয়ন? এই ঝাঁ চকচকে সুউচ্চ ভবন, প্রশস্ত তকতকে মহাসড়ক বা বিশাল বিশাল সেতু; অবশ্যই উন্নয়নের মাপকাঠি। অগ্রগতিরই ইঙ্গিত দেয় এসব। কিন্তু সেই ভবনে গিয়ে যদি পুড়ে মরতে হয়, মহাসড়কে গিয়ে যদি দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়, হাসপাতালে চিকিৎসা মেলে না, এই উন্নয়নের মূল্য কোথায় রইলো? অভিশপ্ত এই উন্নয়ন থেকে মেঠো পথ আর কুঁড়েঘরই তো ভালো ছিল।
শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলেই হবে না, এর সঙ্গে সুশাসনও জরুরি। তবেই টেকসই উন্নয়ন হবে। নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার। দেশে সুশাসন থাকলে ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা থাকতো, সড়কে নিয়ন্ত্রণ থাকতো, খাবারে বিষ থাকতো না। বাতাস থাকতো পরিশুদ্ধ। গায়ে গা ঘেঁষে এতগুলো সুউচ্চ ভবন নির্মাণ হতো না। দেশের অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর আরও আধুনিক হতো। নতুন নতুন যন্ত্রপাতি থাকতো। সুশাসন না থাকলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখিয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে কৃতিত্ব জাহির করা যাবে, কিন্তু মৃত্যুর মিছিল থামবে না।
বেশ কয়েকমাস আগে বনানীতে ফায়ার সার্ভিসের পাইপের ছিদ্র চেপে ধরা সেই বালকের ছবিটা আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়ই। এটা একটি