December 23, 2024, 7:25 pm

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে

Reporter Name
  • Update Time : Sunday, May 31, 2020,
  • 133 Time View

লাকমিনা জেসমিন সোমা

মিজদা শহরের সংগঠিত হত্যাকাণ্ডে ঘটনাস্থলে মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি জিম্মি ছিলেন। এছাড়া উক্ত ক্যাম্পে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের আরো শতাধিক নাগরিক বন্দী ছিলেন। এই ক্যাম্পটি মিজদার স্থানীয় একজন লিবিয়ান নাগরিকের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল, যার বয়স মাত্র ৩০ বছর। লিবিয়া সরকারের তথ্যমতে, তার নামে বিভিন্ন অপরাধ ও মানবপাচারের অভিযোগ ছিল। এছাড়াও তার সহযোগী হিসাবে আরও কয়েকজন অস্ত্রধারী কাজ করত। তারা স্থানীয় কোন মিলিশিয়া গ্রুপের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। এই চক্রটি মূলত মরুভূমির মধ্য দিয়ে পাচারের সময় আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের জিম্মি করে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করত।

আহত বাংলাদেশি ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া তথ্য মতে, বর্ণিত বাংলাদেশিরা করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পূর্বে ক্ষেত্র বিশেষে ৬-৭ মাস আগে মানবপাচারকারীদের সহযোগিতায় লিবিয়ার বেনগাজীতে আগমন করেন। তারা মূলত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ গমনের উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় এসেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে ইতালি যাওয়া কঠিন হয়ে যাওয়ায় তারা দীর্ঘদিন ধরে বেনগাজীতে আটকে পড়েন। বর্তমানে সামার সিজন শুরু হওয়াতে পাচারকারীরা কিছু কিছু অভিবাসীদের লিবিয়ার পশ্চিম উপকূল হতে ইতালি প্রেরণ শুরু করে। যদিও তাদের বেশিরভাগ নৌকাই লিবিয়ার কোস্টগার্ডের নিকট আটক হচ্ছে। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে বাংলাদেশি দালাল কর্তৃক প্রচারিত সাগর পথে বাংলাদেশিদের ইতালি পৌঁছানোর ভিডিও ফেইসবুকে ভাইরাল হয়। যা দেখে তারা যেকোন উপায়ে ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে আসার চেষ্টা শুরু করেন।

এই অবস্থায় বর্ণিত ৩৮ জন দুই গ্রুপে লিবিয়ার স্থানীয় বাংলাদেশি দালালদের সহযোগিতায় ১০-১৫ দিন পূর্বে মরুভূমি হয়ে বেনগাজী থেকে পশ্চিম লিবিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। লিবিয়ায় বর্তমানে যুদ্ধ ও করোনার কারণে পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলের শহরে যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পাচারকারীরা মরুভূমির অপ্রচলিত পথ দিয়ে তাদেরকে প্রেরণ করে। পথে চেকপয়েন্ট এড়ানোর জন্য মরুভূমির মধ্যে তাদেরকে অনেক পথ ঘুরতে হয়। বেনগাজী থেকে যাত্রার দুইদিন পর তাদেরকে প্রথমে এক অপহরণকারী চক্র ধরে মরুভূমিতে এক ঘরে আটকে রাখেন। এই চক্র জিম্মিদের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার বা নির্যাতন করেনি বলে বাংলাদেশিরা জানিয়েছে।
তিনদিন পর জিম্মিদেরকে সারারাত ভ্রমণের পর মিজদার পাচারকারীদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে প্রথম গ্রুপটি অর্থের বিনিময়ে মিজদার গ্রুপের নিকট জিম্মিদের বিক্রি করেছে। মিজদায় আনার পর থেকে শুরু হয় তাদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন। অপহরণকারীরা মুক্তিপণ হিসাবে প্রত্যেক জনের কাছ থেকে ১০-১২ হাজার মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দাবী করতে থাকে এবং মুক্তিপণের অর্থ দুবাই প্রেরণের কথা জানান। মুক্তিপণ আদায়ে বিলম্ব হওয়ায় দিনকে দিন নির্যাতন বাড়তে থাকে।

লিবিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া এবং আহতদের দেওয়া তথ্য মতে, গত ২৭ মে ২০২০ তারিখ দিবাগত রাতে অপহরণকারীর মূলহোতা ও তার দুয়েকজন সহযোগী পুনরায় অস্ত্রসহ জিম্মি অভিবাসীদের ক্যাম্পে আসে এবং নির্যাতন শুরুর একপর্যায়ে কয়েকজন আফ্রিকার নাগরিক তার অস্ত্র কেড়ে নিতে সক্ষম হয়। যাতে কয়েকজন বাংলাদেশিও সহযোগিতা করে থাকতে পারে বলে জানা যায়। এই অবস্থায় আফ্রিকান নাগরিকের ছোড়া গুলিতে অপহরণকারী মূলহোতা নিহত হন এবং তার সহযোগী আহত হন।

তবে এই খবরটি নিহত লিবিয়ানের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছে বাংলাদেশিরা তাকে হত্যা করেছে বলে পৌঁছায়। একপর্যায়ে তারা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে সশস্ত্রভাবে জিম্মি অভিবাসীদের ক্যাম্পে হামলা চালায় এবং নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। যার ফলে এই বর্বরোচিত হতাহতের ঘটনা ঘটে। যদিও লিবিয়ার সোশ্যাল মিডিয়াতে উক্ত অপহরণকারী আফ্রিকানদের হাতে নিহত হয়েছেন বলে শুরু থেকেই প্রচার হয়েছে।

এই বিষয়ে বিভিন্ন উপায়ে মিজদার কয়েকজন লিবিয়ানের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিহত লিবিয়ানের বাড়িটি একটি বিশালাকার প্রাসাদ। যার পিছনে কিছুটা আন্ডারগ্রাউন্ডে সে অভিবাসীদের জিম্মি রাখার আস্তানা তৈরি করেছিল। এই প্রাসাদের আশেপাশে সবই তার আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। কিন্তু তার আত্মীয়স্বজন ছাড়া স্থানীয়রা এইখানে অভিবাসীদের বন্দিশালার বিষয়ে কেউ জানত না।

ঘটনার দিন নিহত লিবিয়ানের আত্মীয়স্বজনরা এলাকাবাসীকে কিছু টেরোরিস্ট গ্রুপ তাদের ছেলেকে হত্যা করেছে বলে ভুল বুঝিয়ে ক্ষিপ্ত করেছিল। স্থানীয়রা জানতোই না ভিতরে বাংলাদেশি আছেন। এমনকি নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও এদেরকে টেরোরিস্ট বলে প্রচার করেছিল। ঘটনার পরপরই কিছু কিছু সোশ্যাল মিডিয়ায় নিহতদেরকে লিবিয়ায় যুদ্ধরত প্রতিপক্ষের ভাড়াটে সৈন্য বলেও দাবী করা হয়েছিল। কিন্তু নিহতরা বাংলাদেশি হওয়ায় সকলে বিস্মিত হয়ে যায়। বর্তমানে স্থানীয় মিজদার নাগরিকরা এই ঘটনায় অনুতপ্ত বলে তারা জানিয়েছেন।

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় জিম্মি ৩৮ জন বাংলাদেশির মধ্য ৩৫ জনের পরিচয় ত্রিপলীর বাংলাদেশ দূতাবাস নিশ্চিত করেছে। যাদের মধ্যে সম্ভাব্য নিহত ২৬ জনের মধ্য ২৩ জন এবং আহত ১১ জনসহ বেঁচে যাওয়া ১২ জনের পরিচয় প্রকাশ করেছে। বেঁচে যাওয়া দুইজনের সাথে কথা বললে তারা জানায়, কিভাবে তারা জীবিত আছেন তা পরিষ্কার বলতে পারে না। কোনভাবে কারো নিচে ছাপা পড়ে বা কিনারায় পড়ে থেকে বা মৃত্যুর ভান করে হয়তো তারা বেঁচে গেছেন।

পরবর্তীতে তাদেরকে মিজদা হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেও গণ্ডগোল দেখা দিলে তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত অন্য শহরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পাচারকারীদের ভয়ে তাদেরকে আশেপাশের কোন হাসপাতালে ভর্তি নেয়নি। এক পর্যায়ে তাদেরকে জিনতান হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে ত্রিপলীতে পাঠানো হয়। বর্তমানে আহত ১১ জন বাংলাদেশি ত্রিপলীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে বলে দূতাবাস জানিয়েছে। অন্যদিকে এই ঘটনায় নিহত সকলের মৃতদেহ ইতিমধ্যে মিজদায় দাফন করে ফেলা হয়েছে।

এই মর্মান্তিক ঘটনার মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে সাগর পথে ইউরোপ যাওয়ার ২৬ জন বাংলাদেশির স্বপ্নের অন্তিম পরিণাম হলো। এই পথের স্বপ্নে প্রতি বছরই বাংলাদেশিরা প্রাণ দিচ্ছে। গত বছর এক নৌকাডুবির ঘটনায় ৩৭ জন ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুবরণ করেছিল, যাদের লাশও পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রতি বছর শতশত বাংলাদেশি লিবিয়ার কোস্টগার্ড

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71