December 26, 2024, 12:37 pm

কিটের ৬০০ কোটি টাকা বাকি, মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করোনা পরীক্ষা

অনলাইন ডেস্ক
  • Update Time : Wednesday, July 1, 2020,
  • 138 Time View

দেশে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষার শুরু থেকে এ পর্যন্ত যত কিট সরকার সংগ্রহ করেছে সে সবের বিলই বকেয়া রয়েছে। কেবল কিটই নয়, নতুন স্থাপনকৃত পিসিআর মেশিন, এমনকি চিকিৎসাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীরও (পিপিই) কোনো বিল পরিশোধ করা হয়নি।

টাকা না পেয়ে কিট ও মেশিন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এখন ওই সরবরাহকারীদের একদিকে বোঝানো এবং অন্যদিকে নতুন সরবরাহকারী খুঁজে বের করারও চেষ্টা চলছে।

সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ১৫ লাখ কিট আনা হয়েছে দেশে, যার মূল্য প্রতিটি দুই হাজার ৭০০ টাকা দরে প্রায় ৪০৫ কোটি টাকা। এই বিল পরিশোধ করা হয়নি।

পিসিআর মেশিন বাবদ প্রায় ২০০ কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে। পিপিইসহ অন্য উপকরণের বিল বকেয়া রয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ও তথ্য-উপাত্ত থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিল পরিশোধ নিয়ে জটিলতার কারণ হিসেবে জানা গেছে, কেনাকাটায় সঠিক প্রক্রিয়া বা বিধি-বিধান অনুসরণ না করা, কখনো বা তাত্ক্ষণিক মৌখিক নির্দেশে সরবরাহ নেওয়া এবং অতিরিক্ত দামসহ আরও কিছু দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত শুরু হওয়া।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন যেকোনো কেনাকাটা বা বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করছে। জরুরি পরিস্থিতির কেনাকাটা হলেও এই মুহূতে উপযুক্ত বিধি-বিধান অনুসরণ ছাড়া সাহস করছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে এ ক্ষেত্রেও এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

শুধু বিলই নয়, এর সঙ্গে আরেক জটিলতা তৈরি হয়েছে আমদানি করা প্রায় আট লাখ কিট ফেরত দেওয়া নিয়েও। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতির কারণে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে দেশে করোনা পরীক্ষা কার্যক্রম।

এ অবস্থায় একটি কিট দিয়ে দুটি নমুনা পরীক্ষার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শুরুতে ১০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে জরুরি ভিত্তিতে কিট সরবরাহ করার আদেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

কখনো বা মৌখিক নির্দেশনা পেয়েও কেউ কেউ নিজেরা বিদেশ থেকে দ্রুত সময়ের মধ্যে কিট এনে সরবরাহ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। তবে এর মধ্যে ভাগে ভাগে প্রায় সাত লাখ কিট এনেছে এককভাবে একটি প্রতিষ্ঠান, যাদের ওই কিট আনা হয়েছে চীন থেকে।

বাকি আটটি প্রতিষ্ঠান প্রায় এক লাখ করে কিট এনেছে কোরিয়া, ইতালিসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে। চীনের কিটগুলোর মতোই অন্য দেশের কিটও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বুঝে নিয়ে বিভিন্ন ল্যাবে বিতরণ করেছে।

কিন্তু একপর্যায়ে ওই সব কিট ফেরত দেয় বিভিন্ন ল্যাব। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সেসব কিট ফেরত নিতে বলে সরবরাহকারীদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চীন ছাড়া অন্য যেসব দেশের কিট সরবরাহ করা হয়েছে সেটা পিসিআর মেশিনে সেট হয় না বা সেট করতে দেরি হয়, এমন কারণ দেখিয়ে ফেরত নিতে বলা হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে।

অন্যদিকে সরবরাহকারীরা তাদের বিল পরিশোধে চাপ দিতে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। তাতে সাড়া না পেয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানা অজুহাত দেখিয়ে কিট সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘সরবরাহকারীরা কোটি কোটি টাকা মূলধন খাটিয়ে লাখ লাখ কিট এনে দিয়েছে। এখন যদি তারা ওই বিল না পায় কিংবা আবার কারও কারও কিট নানা অজুহাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ফিরিয়ে দেয় সেটা সরবরাহকারীদের পথে বসানোর শামিল হবে।

বকেয়া বিল না পেলে তারা আবার কিট আনার টাকা পাবে কোথায় এ ছাড়া যারা পিসিআর মেশিন সরবরাহ করেছে তারাও বিল পাচ্ছে না। ফলে এখন আবার তাদের কাছে মেশিন চাইলে তারা কিভাবে দেবে?’

ওই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, যে অজুহাত দেখিয়ে সাত-আট লাখ কিট ফিরিয়ে দেওয়া চেষ্টা চলছে সেটা সঠিক নয়। কিটগুলো দেশে থাকা সব পিসিআর মেশিনেই সেট হয় এবং পরীক্ষাও হয় সঠিকভাবেই। এখানে অন্য কোনো ব্যাপার থাকতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।

কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ কিটগুলোর কার্যকারিতার মেয়াদ থাকে ছয় মাস। এর মধ্যেই কারো কারো কিটের মেয়াদ দেড়-দুই মাস চলে গেছে। ফলে ওই সরবরাহকারীদের কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে এখন কম দামে হলেও প্রাইভেট ল্যাবগুলোকে কিছু কিছু করে সরবরাহ করতে শুরু করেছে।

প্রাইভেট ল্যাবে যে কিট ব্যবহার করা যায় তা কেন একই মেশিনে সরকারি ল্যাবে ব্যবহার করা যাবে না, সেটা বোধগম্য নয়।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, করোনা পরীক্ষায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে সবচেয়ে বেশি কিট দেওয়া বা এখন এককভাবে চীনের সব কিট সরবরাহকারী দেশীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশন (ওএমসি), যারা একই সঙ্গে পিসিআর মেশিনসহ আরও কিছু উপকরণ দিচ্ছে। কিন্তু এই বড় প্রতিষ্ঠানটিও কিছুদিন ধরে বেঁকে বসেছে বিলের জন্য।

তাদের বকেয়া ২০০ কোটি টাকার বেশি হবে বলে জানায় একাধিক সূত্র। যদিও ওই প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে রাখঢাক করছে।

অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরেই এককভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে বা তাদের কাজ দেওয়ার জন্যই অন্যদের কিট গ্রহণ করা হচ্ছে না।

ওএমসির অন্যতম পরিচালক মারুফ মান্নান বলেন, ‘বিলের জন্য কিট বা মেশিন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছি—এই কথা সঠিক নয়। শুধু আমাদেরই নয়, কারও বিলই তো দিচ্ছে না।

অন্যরা কেন কিট দিচ্ছে না সেটা আমি বলতে পারব না। আমরা কেন দিচ্ছি না সেটাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই ভালো বলতে পারবে।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক  ও অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, ‘আগে কী হয়েছিল না হয়েছিল সেটা আমি বলতে চাই না। আমি দায়িত্ব নিয়েছি ২৭-২৮ দিন।

এর আগে কোন প্রক্রিয়ায় কাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল, বিধি-বিধান মানা হয়েছিল কি হয়নি, সেটাও আমি দেখতে চাই না। তবু যেহেতু বিষয়টি আমার নজরে এসেছে তাই আমি আগের বিল ও ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সুরাহার জন্য নির্দেশনা চেয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। সেখান থেকেই বিষয়টির সমাধান আসবে বলে আশা করি।’

অতিরিক্ত সচিব আরও বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত দুটি প্রতিষ্ঠানকে কিটের কার্যাদেশ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি সপ্তাহে প্রায় এক লাখ কিট হাতে পাওয়া যাবে।

এ ছাড়া আগের যে কিটগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে কথা উঠেছে সেই কিটগুলো থেকে কিছু কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’

ওই কিটগুলোর সমস্যা সম্পর্কে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি যতটা জেনেছি সেটা হচ্ছে, ওই কিটগুলো কোনো কোনো ল্যাবের মেশিনে প্রপারলি সেট হয় না, আবার সময় খুব বেশি লাগে। এখন যেহেতু আমাদের কাজ চালিয়ে দেওয়া জরুরি তাই দেরি হলেও ওই ধরনের কিছু কিটের সাপোর্ট নেওয়া যেতে পারে, যা নিয়ে ওই সরবরাহকারীদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।

’ তিনি বলেন, হাতে এখনো যে পরিমাণ কিট আছে তা দিয়ে আগামী দুই সপ্তাহ চলবে। এর মধ্যে অন্য সব জটিলতা কাটিয়ে আরো সরবরাহ পাওয়ার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।

সিএমএসডির পরিচালক জানান, কিটের সংকটের চেয়ে বরং সরবরাহ সংকটটাই বেশি। কোনো এলাকার ল্যাবে হয়তো কিট বেশি আছে, কোনো এলাকার ল্যাবে কম আছে। যেখানে কম সেখানে এক দিন বেশি চাপ পড়লে ঘাটতির প্রশ্ন ওঠে।

আর সেখান থেকে কেন্দ্রে খবর আসার পর কিট পৌঁছাতে হয়তো কয়েক ঘণ্টা বা দু-এক দিন সময় লেগে যায়।

তিনি বলেন, কিট সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে একটি কিট (আরটিপিসিআর কিট) দুই ভাগ করে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এতে করে এক কিটে দুজনের নমুনা পরীক্ষা করা যাবে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71