ঝিনাইদহ সদরে আবাবা নামে একটি অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আশিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন-সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের ইয়াহিয়া মুন্সীর ছেলে তাবিবুর রহমান (৩০) ও ডেফলবাড়িয়া গ্রামের সবুজ হোসেনের স্ত্রী সমাপ্তি খাতুন।
পুলিশ সুপার জানান, বুধবার রাতে সদর উপজেলার আলাদা স্থান থেকে ওই দু’জনকে গ্রেফতার করে জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল। ডিজিটাল জালিয়াত চক্রের সদস্যরা আবাবা অ্যাপসের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করছেন- এমন খবরে তদন্ত শুরু করা হয়। তদন্তে সত্যতা পাওয়ায় সদরের ভেন্নাতলা এলাকা থেকে তাবিবুর রহমান ও পরে রামনগর এলাকা থেকে সমাপ্তি খাতুনকে গ্রেফতার করা হয়।
চক্রটি ওই অ্যাপসের মাধ্যমে বিনিয়োগ করিয়ে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আসছিল। এ চক্রের বাকি সদস্যরা কম্বোডিয়ায় বসে এটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। অ্যাপসটি কম্বোডিয়া থেকে পরিচালনা করে সবুজ হোসেন, শোভন আহমেদ, আহসান শুভ, সোহাগ আহমেদ, হায়দার খান সাগর, মোতাহার হোসেন।
কম্বোডিয়াতে আবাবা অ্যাপসের অফিসে কাজ করতেন এমন একজন (পরিচয় গোপন রাখা শর্তে) জানান, তারা শুধু অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতারণা করাই নয়, প্রত্যেকেই জড়িত মানবপাচারের সাথে।
তারা বাংলাদেশের থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য পাশকৃত ফ্রেশার যুবকদের টার্গেট করে উচ্চ বেতনের কম্পিউটার অপারেটরের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে কম্বোডিয়াতে পাচার করে বিভিন্ন চাইনিজ অনলাইন স্ক্যামিং বা অনলাইন প্রতারনা কোম্পানির কাছে ৪-৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। ভালো দাম পাওয়ার আশায় কম্বোডিয়াতে পাচার করার পর দেওয়া হয় বিশেষ প্রতারণার ট্রেনিং, এই ট্রেনিং দিয়ে থাকেন হায়দার খান সাগর এবং মোতাহার হোসেন। পাসপোর্ট রেখে দেন তাদের কাছে জিম্মি।
বিক্রি হবার পর নিরীহ যুবকদের উপর নেমে আসে নরকের ছায়া। চাইনিজ কোম্পানির প্রতারনার টার্গেট পূরন না করতে পারলে চলে অমানবিক নির্যাতন। কেড়ে নেওয়া হয় মোবাইল ফোন, দেওয়া হয় ইলেকট্রিক শক। এভাবে সপ্তাহখানিক চলার পর দাবি করা হয় মুক্তিপণের টাকা। বাংলাদেশে পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করে বের হতে হয় কোম্পানি থেকে। বের হওয়ার পর পাসপোর্ট জিম্মি করে চলে নানা ধরনের টালবাহানা। পাসপোর্ট না দিয়ে এক পর্যায়ে প্রস্তাব দেওয়া হয় তাদের নিজস্ব প্রতারণা কোম্পানিতে কাজ করার।
বাংলাদেশকে টার্গেট করে চলে আবাবা সহ তাদের বেশ কয়েকটি জুয়ার ওয়েবসাইট। শেষ পর্যায়ে পাচারকৃতদের দিয়ে জোর পূর্বক তাদের অ্যাপসে প্রতারনার কাজ করনো হয়। কেউ কেউ কপাল গুণে দেশে চলে আসলেও চলতে থাকে তাদের হুমকি ধমকি। তাদের এইসব অপকর্মে সকল ধরনের প্রযুক্তিগত সাপোর্ট দিয়ে থাকে হায়দার খান সাগর।
আহসান শুভ, শুভন আহমেদ, সোহাগ আহমেদ, হায়দার খান সাগর, মোতাহার হোসেন, জসিম উদ্দিন কম্বোডিয়াতে একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্র হয়ে কাজ করেন। এই চক্রটি এখন পর্যন্ত কম্বোডিয়াতে সর্বোচ্চ সংখ্যক নিরীহ বাংলাদেশিদের পাচার করেছ, যার সংখ্যা ৬০০ এর উপরে।
কম্বোডিয়া ফেরত একজন পাচারকৃত ভূক্তভূগি জানান দরিদ্র পরিবারের সন্তান আহসান শুভ কম্বোডিয়াতে যান জীবিকার তাড়নায়। একটি চাইনিজ অনলাইন স্ক্যামিং কোম্পানিতে একজন সাধারণ কর্মরত থাকা অবস্থায় একজন চায়নিজ মানবপাচারকারীর সাথে পরিচয় হয়। সেখান থেকে বের হয়েই শুরু করেন বাংলাদেশ থেকে কম্বোডিয়ার মানবপাচার করে বিক্রি। পাচার করে বিক্রি করেছেন প্রায় ১৫০ জন বাংলাদেশিকে। চক্রের সাথে মিলে পরিচালনা করেন আবাবা অ্যাপস।
শুভন আহমেদ শুধু একজন মানবপাচারকারীই নন, অন্যান্য মানবপাচারকারীদের জন্যও তিনি কৃতদাশ বিক্রির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। রয়েছে বেশ কয়েকটি নিজস্ব অনলাইন প্রতারণার ওয়েবসাইট এবং অ্যাপস। এখন পর্যন্ত পাচার করে বিক্রি করেছেন ২০০ এর কাছাকাছি বাংলাদেশিকে। কাজ করেন সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী চক্রের সাথে। সূত্র জানায়, রাজধানী নমপেন এয়ারপোর্টের কাছে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে চলে শুভনের মালিকানাধীন প্রতারণার কয়েকটি অ্যাপস।
হায়দার খান সাগর নিজেকে এয়ারটিকেট ও মোবাইল ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও আদতে একজন পোক্ত মানবপাচারকারী এবং প্রতারক। ২০১৮ সালে মানবপাচারের অভিযোগে তাকে চায়নিজ সরকার চায়নাতে ব্লাকলিস্ট করে এবং ৫ বছরের কারাদন্ড দেয়, কোনো রকমে সেখান থেকে বেচে পালিয়ে টুরিস্ট ভিসায় কম্বোডিয়া চলে আসেন কিন্তু সেখানেও থেকে যান অবৈধ ভাবে। সেখানে এসে শুরু হয় তার পাপের আরেক রাজত্য। চোরাই মোবাইল বাংলাদেশে ঢোকানো এবং মানবপাচার ব্যবসায় জরিত থাকার দরুন তার বাংলাদেশ কাস্টমস এবং কিছু অসাধু এয়ারপোর্ট কর্মকর্তার সাথে পরিচয় এবং লেন্-দেন ছিল। সেটা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিরীহ অসহায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইউরোপ এবং কানাডা পাঠানোর স্বপ্ন দিয়ে কম্বোডিয়াতে পাচার করতে থাকেন। ধিরে ধিরে আরো কয়েকজন সহকারী নিয়ে গড়ে তোলেন মানবপাচারকারী চক্র। এখন পর্যন্ত পাচার করে বিক্রি করছেন ১০০ এর বেশি বাংলাদেশিকে। আবাবা অ্যাপসের পার্টনার এবং প্রযুক্তিগত দিক দেখাশুনা করেন হায়দার খান সাগর।
“আবাবা” অ্যাপসের প্রতারণার টাকা হুন্ডি তথা মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় পাচারের মূল হোতা হায়দার খান সাগর এবং মোতাহার হোসেন।
মোতাহার হোসেন শুরুতে বাংলাদেশি নারীদের চায়নাতে পাচার করতেন চায়নিজদের স্ত্রী হিসেবে পাসপোর্ট বানিয়ে। একবার ধরা পরার পর চলে যান ফিলিপাইনে। সেখানে থাকাকালীন অবস্থায় সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় মানবপাচার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন এবং ফিলিপাইন ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল ডিপার্মেন্ট তার নামে মামলা দায়ের করেন। সেখান থেকে পালিয়ে আসেন কম্বোডিয়া। সেখানে এসে নিজে বিক্রি হয়ে যান এক ক্যাসিনো। ৬ মাস সেখানে চাকরি করার অবস্থায় ৩য় মাসে তিনি জানতে পারেন, এখানে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি নিজে শুরু করেন বাংলাদেশ এবং ফিলিপাইন থেকে মানবপাচার করে কম্বোডিয়াতে বিক্রি করা। তিনি ইতো মধ্যে ১৫০ এরও বেশি ফিলিপিনি এবং বাংলাদেশিকে পাচার করে বিক্রি করেছেন। “আবাবা” অ্যাপসের প্রতারণার টাকা হুন্ডি তথা মানি লন্ডারিং এর মাধ্যমে কম্বোডিয়ায় পাচারের দায়িত্ব পালন করে থাকেন মোতাহার হোসেন।
সোহাগ আহমেদ এবং জসিম উদ্দিন নিরীহ যুবকদের কম্বোডিয়াতে পাচার করে বিক্রি করে। কম্বোডিয়ার অবস্থানরত সাধারণ কন্সট্রাকশন কর্মীদের প্রলোভন দেখি তাদের কাছ থেকে তাদের আত্মীয়-সজন এর পাসপোর্ট নিয়ে জাল ভিসা দিয়ে প্রতারিত করে, হায়দার কম্পিউটার এক্সপার্ট হওয়ার সুবাদে জাল ভিসা বানানোর কাজ হায়দার সম্পন্ন করে। প্রতারিতরা অভিযোগ নিয়ে আসলে তাদের গায়ের জোরে প্রতিহত করে জসিম-সোহাগ এবং হায়দার, মোতাহার গ্রুপ। ভূক্তভূগিদের মধ্যে অনেকেই দেশে যেতে পারছে না দেনার দায়ে। এখন পর্যন্ত সোহাগ ও জসিম ১৫০ এরও বেশি বাংলাদেশিকে কম্বোডিয়ায় পাচার করে বিক্রি করেছে। সোহাগ আহমেদ আবাবা অ্যাপসের মূল পরিকল্পনাকারী পার্টনার এবং বাংলাদেশে মার্কেটিং এর কাজ করে থাকেন।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার সাঈদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবুল বাশারসহ সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে ছয়জনকে আসামি করে সদর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে। বিকেলে আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়।