ভূমি মহান আল্লাহর এক অপরূপ সৃষ্টি। ভূমির মালিকানা মহান আল্লাহর। তবে এর ব্যাবহারিক মালিক—জনসাধারণ ও রাষ্ট্র। সাধারণত ভূমি বলতে পৃথিবীর স্থলভাগের অংশ বিশেষ তথা মাটিকে বোঝায়।
পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদরা সব প্রাকৃতিক সম্পদকে ভূমি বলে থাকেন। ইসলামী অর্থনীতিতে যেসব বস্তুগত সম্পদকে উৎপাদন কার্যে ইজারা বা ভাড়া খাটানো হয় এবং যা উৎপাদনের উপাদান হিসেবে ব্যবহারের সময় সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায় না, তাকেই ভূমিস্বত্ব বলে। ভূমি ব্যবহারে ইসলামের নির্দেশনা নিম্নরূপ—ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে ভূমি : মহান আল্লাহ ভূমিকে ব্যবহারের উপযোগী করেই সৃষ্টি করেছেন। ভূমিকে পানির মতো নরম করা হয়নি, যার ওপর স্থির হয়ে দাঁড়ানো যায় না; আবার লোহা বা পাথরের মতো এত শক্ত করা হয়নি, যা সহজে ব্যবহার করা যায় না; বরং নরম ও শক্ত—এই দুয়ের মধ্যবর্তী সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে মানুষ সহজে ভূমি ব্যবহার করে তা থেকে জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য জমিনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাজিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি, তোমাদের জন্য রিজিকস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২)
ভূমির যথার্থ ব্যবহার : ভূমির যথাযথ ব্যবহার আবশ্যক। কৃষি জমিতে চাষাবাদ ও বনায়ন করতে হবে। নিজে আবাদ করতে না পারলে অন্যকে বর্গা অথবা এমনিতেই আবাদ করতে দিতে হবে। জায়গাজমি পতিত রাখা যাবে না। অকৃষি জমিতে ঘর-বাড়ি, খামার, বাণিজ্যিক অথবা অবাণিজ্যিক স্থাপনা অথবা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করতে হবে। বাড়ির আশপাশের খালি জায়গা, বাড়ির ছাদ, বাড়ি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ পাওয়া ফাঁকা প্লট এবং নিজ নিজ মালিকানাধীন জায়গা জমির যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত হলে জাগতিক জীবনেও জাতির অবস্থা কখনোই শোচনীয় হবে না। জমি পতিত না রাখতে হাদিসে বারবার বলা হয়েছে। জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যার কাছে জমি আছে সে যেন তা (নিজে) চাষাবাদ করে। যদি সে (নিজে) চাষাবাদ না করে তবে যেন তার কোনো ভাইকে চাষাবাদ করতে দেয়। ’ (মুসলিম: ৩৭৭৩)
পতিত ভূমির ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ : ভূমির যথাযথ ব্যবহার না হলে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে পারে। ভূমির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে উমর (রা.) বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এগুলোর অন্যতম ছিল—ক্রমাগত তিন বছর জমি অনাবাদি রাখলে ওই জমির ওপর ভূমি মালিকের কোনো বৈধ অধিকার থাকবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিলাল (রা.)—কে একখণ্ড জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিলাল (রা.) সে জমি ঠিকমতো চাষ করতে পারছিলেন না। তাই উমর (রা.) তাকে অনুরোধ করলেন, ‘তিনি যেন জমিটির উপযুক্ত ব্যবহার করেন, অন্যথায় নির্দিষ্ট সময় পরে ওই জমিকে রাষ্ট্রের বলে ঘোষণা করা হবে। ’ বিলাল (রা.) যুক্তি দিলেন, ‘এটি রাসুলুল্লাহ (সা.) দান করেছিলেন, বিধায় তিনি এটিকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতি হিসেবে গণ্য করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত জমি তিনি কিছুতেই ত্যাগ করবেন না। ’ জবাবে উমর (রা.) তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন যে ‘যদি বিলাল (রা.) জমির উপযুক্ত ব্যবহার না করেন, তাহলে তিনি বাধ্য হবেন আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.)-এর আদেশ পালন করতে। ’ অর্থাৎ এ জমি ছিনিয়ে নিতে। পরে উমর (রা.) তাই করেছিলেন। (ইউনিট-৩, ইসলামিক স্টাডিজ-৫, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, হযরত উমরের ভূমি সংস্কারনীতি, পৃষ্ঠা ৭৮)
সরকারি ভূমির ব্যবহার : রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে সরকারের জমি-জায়গার প্রয়োজন হয়। সরকারি অফিস-আদালতের স্থান, চারণভূমি, রাস্তা, সেনানিবাস, পার্ক, খেলার মাঠ, বাজার, পুকুর, খাল-বিল এবং রাষ্ট্রের সীমানায় অবস্থিত সমুদ্র, নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, বিল-হ্রদ, পাহাড়-পর্বত, বন-বনানি, নদীতে জেগে ওঠা চর, দ্বীপ ও মরুভূমি রাষ্ট্রের মালিকানাধীন জমিতে পরিণত হয়। অনুরূপভাবে যুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা দেশে বিজিত শক্তি দেশ ছেড়ে চলে গেলে তাদের রেখে যাওয়া স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তিও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে সরকার জনগণের কাছ থেকে যথার্থ মূল্যে জমি কিনে রাষ্ট্রীয় কাজে তা ব্যবহার করতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কৃষি জমি থাকলে তাতেও চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। নবী করিম (সা.) বনু কায়নুকা, বনু নাজির, বনু কুরায়জা থেকে গনিমত, খুমুস ও ফাই হিসেবে যে সম্পত্তি পেয়েছিলেন, তা মদিনার মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। খায়বারের সম্পত্তিকে তিনি তথাকার ইহুদি চাষিদের মধ্যে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকের বিনিময়ে চাষ করতে দেন। ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) খায়বারের জমি ইহুদিদের এ শর্তে বর্গা দিয়েছিলেন যে তারা তাতে পরিশ্রম করে কৃষিকাজ করবে এবং উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তারা পাবে। (বুখারি, হাদিস: ২১৮০)
ভূমি দখল বন্ধ করা : সরকারি বা মালিকানাধীন কোনো প্রকার জায়গা-জমি অন্যায়ভাবে ভোগ-দখল করা কঠিন অপরাধ। এক বিন্দুও নিজ জমির সীমানা অতিক্রম করা যাবে না। এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করার অর্থ কিয়ামতের দিন সাত স্তর জমিনের বেড়িতে আটকে পড়া। সাঈদ ইবনু জায়িদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি জোরপূর্বক এক বিঘত পরিমাণ জমি দখল করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত স্তর জমিনের বেড়ি লাগিয়ে দেওয়া হবে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৩৯৯০)
পরিশেষে বলা যায়, ভূমির যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায়, তাঁর নির্দেশনা পালন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়