ছিয়াশির বিশ্বকাপ কি কখনো ভোলার মতো? কী ছিল না সেই বিশ্বকাপে?
কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ (হাত দিয়ে গোল) কিংবা বিতর্কিত ওই গোলের চার মিনিট পর তার করা ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ (শতাব্দী সেরা গোল)। মেক্সিকো বিশ্বকাপটা আসলে ছিল শুধুই ম্যারাডোনার। পুরো আসরে তার পায়ের মূর্ছনায় মাতে বিশ্ব। ৮ বছর পর বিশ্বকাপ ওঠে আর্জেন্টিনার হাতে।
বলতে গেলে প্রায় এককভাবে আর্জেন্টিনার ট্রফি ক্যাবিনেটে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
মহা আলোচিত সেই বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনা আরও দুইবার শিরোপা ছুঁয়ে দেখার দ্বারপ্রান্তে ছিল। তবে ১৯৯০ এবং ২০১৪ জার্মানির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় আর্জেন্টিনার। ম্যারাডোনা পরবর্তী সময়ে লিওনেল মেসির হাত ধরে বিশ্বকাপ ট্রফি জেতার স্বপ্ন বুনেছিল আর্জেন্টাইনরা। তবে বারবার হচ্ছিল স্বপ্নভঙ্গ। কিন্তু এ বছর সে আক্ষেপ ঘুচেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির। নিজের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ খেলতে কাতার গিয়ে সোনার ট্রফি নিয়েই মাতৃভূমিতে ফেরেন মেসি।
গত ১৮ ডিসেম্বর লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে ফুটবল বিশ্ব আবিষ্কার করে আরেক আইকনকে। বিশ্বকাপ জেতার আগে মেসি যা করেছেন, তাতেই তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। তবে একটা বিশ্বকাপ জয়ের হাহাকার তো ছিলই। লুসাইলে মহানাটকীয় ফাইনালে ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সে অপূর্ণতা ঘোচে এ মহাতারকার। মাথায় ওঠে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। আর্জেন্টিনাও পায় বহুল আকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ ট্রফি।
যেভাবে এলো বিশ্বকাপ
৩৬ বছর পর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের রাস্তা মোটেও সহজ ছিল না। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাতারে পা রাখলেও সেই লুসাইলে আপসেটের শিকার হয় আর্জেন্টিনা। শিকার ধরে সৌদি আরব। অবিশ্বাস্যভাবে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ায় গ্রুপের পরের দুই ম্যাচই আর্জেন্টিনার জন্য নকআউট হয়ে দাঁড়ায়। তবে লিওনেল মেসির নৈপুণ্যে মেক্সিকোকে ২-০ গোলে হারানোর পর শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডকে সমান ব্যবধানে হারিয়ে আসল নকআউট পর্বে পা রাখে আলবিসেলেস্তেরা।
শেষ ষোলতে আর্জেন্টিনা সামনে পায় অস্ট্রেলিয়াকে। পুরো ম্যাচ দাপট দেখালেও শেষদিকে এসে আর্জেন্টিনাকে প্রায় চমকেই দিয়েছিল সকারুজরা। তবে এমিলিয়ানো মার্টিনেজের শেষ মুহূর্তের সেভে আকাশী-সাদারা পায় কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট। যেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে দলটি পায় নেদারল্যান্ডসকে।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে কথার ফুলঝুরি ছোটান নেদারল্যান্ডস কোচ লুই ফন হাল। মাঠের তাই অনেকবার উত্তেজনা ছড়ায় দুই দলের মধ্যে। সেই ম্যাচে স্প্যানিশ রেফারি মাঠ ঠাণ্ডা রাখতে দেখান ১৭ হলুদ কার্ড। আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে থাকলেও নেদারল্যান্ডস বিস্ময়ের জন্ম দেয় শেষ সময়ে। দুই গোল শোধ দিয়ে ম্যাচ নিয়ে যায় অতিরিক্ত সময়ে। এরপর সেখানে দুই দল গোল করতে ব্যর্থ হলে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। যেখানে শেষ হাসি হাসে আর্জেন্টিনা।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্নায়ুর পরীক্ষা দিতে হলেও, সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে রীতিমতো উড়িয়ে দেয় আর্জেন্টিনা। কোচ লিওনেল স্কালোনির কৌশলে রীতিমতো কাবু হয়ে পড়ে জলাতকো দালিচের শিষ্যরা। ফলাফল ৩-০ গোলের জয়ে ৮ বছর পর আরও একটি ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা।
গ্রুপ পর্ব থেকে ফাইনাল-বিশ্ব থেকে বেশ কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ। তবে কাতার বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচটি যেন ফাইনালের জন্যই তুলে রাখা ছিল। কোয়ার্টার ফাইনালের মতো ফাইনালেও প্রথমার্ধে ফ্রান্সের বিপক্ষে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শেষদিকে মাত্র ৯০ সেকেন্ডের ব্যবধানে কিলিয়ান এমবাপ্পের জোড়া আঘাতে ম্যাচে ফেরে সমতা। তখন মনে হচ্ছিল, আরও একটি বেদনার কাব্যে উঠতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা এবং মেসির নাম।
তবে না অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে মেসি ফের এগিয়ে নিলেন আর্জেন্টিনা। পরে আবারও এমবাপ্পের গোলে ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। কিন্তু মেসিতে উজ্জীবিত আর্জেন্টিনা আর পথ হারালো না। টাইব্রেকার নামক লটারি জিতে নেয় আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপ ওঠে মেসির হাতে। আসরজুড়ে দুর্দান্ত খেলে বিশ্বকাপ সেরার পুরস্কারও জিতে নেন মেসি।
বিশ্বকাপ জয়ের পর একদিন কাতারে থেকে দেশে ফিরে আর্জেন্টিনা। এরপর সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে চলে আর্জেন্টাইনদের উৎসব। যে উৎসব এখনো থামেনি। থামবে কী করে, বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফির আলোয় যে এখনো আলোকিত লাতিন আমেরিকার দেশটি।