বরগুনা ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাতালটিতে যোগ হয়েছে আরো দেড়শ’ শয্যা। হাসপাতালের নতুন ভবনটির কাজ এখনো অসামাপ্ত। কিন্তু করোনার সঙ্কটময় মুহূর্তে নতুন ভবনটিকে নাম মাত্র উদ্বোধন করে করোনা রোগীদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নতুন দেড়শ’ শয্যাতো দুর; পুরোনো শতাধীক শয্যাতে লেগেই আছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অবকাঠামোগত জনবল সঙ্কট। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বহুবার রিপোর্ট করা হয়েছে।
স্থানীয় সাংসদও ব্যার্থ হয়েছেন এ সমস্যা সমাধানে। করোনারকালীন সময়ে এই ভোগান্তীময় উপকূলের একমাত্র ভরসা হিসেবে নিরলস চিকিৎসা দিয়েছেন হাসপাতালটির জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. মো. কামরুল আজাদ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১ম থেকে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত মোট মঞ্জুরীকৃত ২শ’ ৩ টি পদের মধ্যে ১ শ’ ১০ টি পদই শূণ্য রয়েছে। কর্মরত রয়েছে মাত্র ৯৩ জন। এত কম সংখ্যক চিকিৎসক ও ব্যবস্থাপনা জনবল দিয়ে জেলা শহরের মত একটি হাসপাতাল কিভাবে পরিচালনা সম্ভব! এমন প্রশ্ন এই জেলার সকল মানুষের মনে।
বরগুনা সদর হাসপাতালটিতে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদ মোট ৪৩ টি। তত্ত্বাবধায়ক সহ রয়েছে মাত্র ৯ জন।
বাকি ৩৪ টি পদই শূণ্য। যেখানে সিনিয়র কনসালটেন্ট ১০ (দশ) টি পদের পুরোটাই শূণ্য। অন্যদিকে জুনিয়র কনসালটেন্ট আছে মাত্র ৪ (চার) জন। থাকার কথা ছিলো মোট ১১ (এগার) জন। হাসপাতালটিতে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ১ জন, ইমারজেন্সী মেডিকেল অফিসার (আইএমও) ৩ জনে রয়েছে মাত্র ১ জন, মেডিকেল অফিসার(এমও) ৪ টি পদই শূণ্য। সহকারী সার্জন ৮ জনে রয়েছে মাত্র ১ জন। ডেন্টাল সার্জন ১ টি পদের ১ টিই শূণ্য।
প্যাথলজিস্ট ও রেডিওলজিস্ট দু’টিই শূণ্য। মেডিকেল অফিসার (হোমিও) পদটি নিটল ক্লিন।
সূত্র আরো জানান, মেডিকেল অফিসার ও সহকারী সার্জন মোট ১৫ জন সদর হাসপাতালটিতে সংযুক্তিতে (প্রেশন) রয়েছে। তবে শুক্রবার (১৬ অক্টোবর সেপ্টেম্বর) হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেলো ভিন্য চিত্র। সংযুক্তিতে কর্মরত ৪ (চার) উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) আউটডোরে রোগী দেখার একমাত্র ভরসা স্থল।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংযুক্তিতে থাকা চার স্যকমো দ্বারাই চিকিৎসা দিয়ে দ্বায় সাড়ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে আউটডোরে ৫ থেকে ৬ শ’ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। করোনার এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে কাউকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। ছিলোনা কর্তৃপক্ষেরো কোন ভূমিকা। ইনডোরে প্রতিদিন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। হাসপাতালটির পুরুষ, নারী ও শিশু ওয়ার্ডেও নেই কোন টেকসই ব্যবস্থা। রোগির সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অধিক লোক প্রবেশ করছে ওয়ার্ডগুলোতে।
অন্যদিকে, হাসপাতালটিতে দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যবস্থ্যাপনায় মঞ্জুরীকৃত পদ মোট ৮৯ টি। যেখানে ৩৩ টি পদই শূণ্য।
রয়েছে মাত্র ৫৬ টি। যার মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ১ টি। পরিসংখ্যান কর্মকর্তা পদটি শূণ্য। নর্সিং সুপারভাইজার ২ জনে রয়েছে ১ জন। সিনিয়র ষ্টাফ নার্স ৭৪ টি পদে রয়েছে মাত্র ৫২ টি। ২২ পদই শূণ্য। ষ্টাফ নার্স ১১ টি পদের ৯ টিই শূণ্য। রয়েছে মাত্র ২ জন।
তৃতীয় শেণির কর্মচারীদের মধ্যে প্রধান সহকারী থেকে শুরু করে টিকেট ক্লার্ক এর মধ্যে কম্পিউটার অপারেটর পদটি শূণ্য রয়েছে। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব:) ৫ টি পদের ২ টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ডেন্টাল) ২ টি পদের ১ টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওগ্রাফী) ৩ টি পদের ২ টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ফার্মাসিষ্ট) ৩ টি পদের ৩ টি, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ফিজিওথেরাপী) ২ টি পদের ২ টি, সহকারী নার্স ৫ টি পদের ৫ টি, লিলেন কিপার ১ টি পদের ১ টি, ইনস্ট্রুমেন্ট কেয়ার টেকার ১ টি পদের ১ টি শূণ্য।
আবার দেখা গেছে, চতুর্থ শেণির কর্মচারীদের মধ্যে অফিস সহায়ক ৫ টি পদের নেই মাত্র ১ টি, বাবুর্চী/সহকারী বাবুর্চী ৩ টি’র মধ্যে নেই মাত্র ১ টি, স্ট্রেরিলাইজার কাম মেকানিক, ডার্করুম সহকারী পদ দু’টি শূণ্য। আউটসোর্সিং এ জনবল কাঠামোতে ২০ টি পদের সবগুলো পদই শূণ্য রয়েছে।
বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয়-
চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদে ৩ জনে রয়েছে মাত্র ১ জন। ১ম শ্রেণি (নন মেডিকেল) ৫ টি পদে রয়েছে মাত্র ৩ জন। ২য় শ্রেণির চারটি পদই পূরণ রয়েছে। ৩য় শ্রেণিতে ১৩ জনে রয়েছে মাত্র ৯ জন। তবে চতুর্থ শ্রেণির ১ টি পদ শূণ্য রয়েছে।
বরগুনা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়-
চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদে ১৩ জনে রয়েছে মাত্র ৯ জন। ১ম শেণির (নন-মেডিকেল) ও দ্বিতীয় শেণির পদ সৃষ্ট হয়নি।
৩য় শ্রেণিতে ১ শ’ ৩১ জনে রয়েছে মাত্র ১শ’ ১৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে পূরণকৃত রয়েছে।
বরগুনার অন্য পাঁচ উপজেলারো একই হাল- একটিতেও ১ম শ্রেণি (নন মেডিকেল) পদগুলো সৃষ্টি হয়নি।
তালতলী ও আমতলী-
তালতলীতে নামে মাত্র ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল থাকলেও হয়ে আছে জাদুঘর। স্থানীয়রা আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর নির্ভর করলেও এখানে চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদে ৩৯ জন থাকলেও কর্মরত রয়েছে মাত্র ২০ জন। ।
২য় শ্রেণির ৩৩ টি পদে রয়েছে মাত্র ২৭ জন। ৩য় শ্রেণিতে ১ শ’ ৩৭ জনে রয়েছে মাত্র ৯০ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে ৪১ জনে রয়েছে মাত্র ২৮ জন।
পাথরঘাটা-
এখানে চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদে ২৮ জনে রয়েছে মাত্র ১৫ জন। ২য় শ্রেণির ২৪ টি পদে রয়েছে মাত্র ১৯ জন। ৩য় শ্রেণিতে ১ শ’ ৬ জনে রয়েছে মাত্র ৬৩ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে ২৩ জনে রয়েছে মাত্র ১৩ জন।
বেতাগী-
চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদে ২৮ জনে রয়েছে মাত্র ১০ জন। ২য় শ্রেণির ২৪ টি পদে রয়েছে মাত্র ১৭ জন। ৩য় শ্রেণিতে ৯১ জনে রয়েছে মাত্র ৬৪ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে ২৩ জনে রয়েছে মাত্র ১৭ জন।
বামনা-
এখানে চিকিৎসকের মঞ্জুরীকৃত পদে ১৪ জনে রয়েছে মাত্র ৭ জন। ২য় শ্রেণির ১৮ টি পদে রয়েছে মাত্র ১২ জন। ৩য় শ্রেণিতে ৫৮ জনে রয়েছে মাত্র ৪৫ জন ও চতুর্থ শ্রেণিতে ১৯ জনে রয়েছে মাত্র ১৩ জন।
বরগুনাবাসী বলছেন, মানুষের মৌলিক অধিকার তার চিকিৎসা। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের মধ্যে দক্ষিণের সাগরঘেঁষা এ উপকূলসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতেই রয়েছে এমন কঠিন সমস্যা।
যা সমাধান হওয়াটা অতি জরুরি। কিন্তু কোথায় এর সমাধান? সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করে বলেন, চিকিৎসাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে অতি শীঘ্রই সেকর খেকে সর্বোচ্চ শিখরে নেয়া দরকার। তা নাহলে এর ভোগান্তী পোহাতে হবে সাধারণ মানুষের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য।
১০০ শয্যা বিশিষ্ট্য বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. সোহরাব উদ্দীন বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অসংখ্যবার চিঠির মাধ্যমে জেলা সদরের এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অন্যন্য জনবল সঙ্কট সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাড. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু মহোদয়ও চেষ্টা করেছেন। তবে চিকিৎসক না থাকার মূল কারণ বরিশাল ডিভিশনের মধ্যে তাদের বাড়ি না হওয়ায় বিভিন্ন তদবিরের মাধ্যমে আসার আগেই চলে যায়।
বদলী ও পদন্নতির সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করলে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারব।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনবল অবকাঠামগত সঙ্কট নিয়ে বরগুনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. হুমায়ুন শাহীন খান বলেন, বরগুনা জেলা সদরসহ বাকি পাঁচ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও একই সমস্যা লেগে আছে। চিকিৎসকদের ঢাকামুখি প্রবণতা ফেরাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সরকারের নীতিমালায় পরিবর্তণ ও জাতিয় পর্যায় গাইড লাইন দরকার। তদবির ছাড়া অটো বদলী ও পদন্নতি হতে হবে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে চাকুরির ধাপগুলো সমন্বয় করা, সঠিক পদবিন্যাশ ও পরিকল্পনাই পারে এ সমস্যা থেকে বের করে আনতে।