December 23, 2024, 10:33 am

আচ্ছা, মানুষগুলো কী সত্যি’ই এতো সুখি?

এস এম সাগর, প্রোগ্রাম অফিসার,স্বাধীন বাংলা টিভি
  • Update Time : Tuesday, December 22, 2020,
  • 132 Time View
Capture

মোবাইল ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙেছে। এতো রাতে তো কারো ফোন করার কথা না। ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি এলিসের ফোন। রাশিয়ান এই মেয়েটার সাথে বছর আটেক আগে পরিচয়। ও তখন আমার এপার্টমেন্টের পাশে’ই থাকতো। কিন্তু হঠাৎ এতো রাতে ফোন!

-হ্যাঁলো।
-আমিনুল, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?
-তাইতো মনে হচ্ছে।
-ধ্যাত, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। দরজা’টা খুলে বাইরে বের হও একটু।
-কি বলছ কিছু’ই তো বুঝতে পারছি না। এই মাঝ রাতে দরজা খুলে বের হবো কেন?
-একটু বের হও না।

বেশ কিছু দিন হয় মেয়েটা শহরের অন্য প্রান্তে চলে গিয়েছে। অনেক দিন সেই অর্থে দেখা হয় না। সে বছর যখন প্রথম পরিচয় হয়; তখন বছরের ঠিক এই সময়’ই ছিল বোধকরি।

ক্রিসমাসের সময়। এই সময়টা’য় এইসব দেশের মানুষজন সাধারণত যে যার দাদা-নানা বাড়ি কিংবা বাবা-মায়ের বাসায় চলে যায়। এক সাথে পরিবারের মানুষজনের সাথে কাটায়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম
– তুমি যাবে না?
মেয়েটা আমার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলেছিল
– আমার আসলে কোথাও যাবার জায়গা নেই।
– দুঃখিত, আমি বুঝতে পারিনি।

সেই রাতে আমরা এক সঙ্গে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। বালটিক সমুদ্রের ধারে হাঁটছিলাম; তখন মেয়েটা বলছিল
– আমার বাবা-মায়ের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। মা এখন তার নতুন সঙ্গী’র সাথে ইংল্যান্ডে থাকে। বাবা অনেক আগে থেকেই অন্য একজনের সাথে থাকছে। আমার অবশ্য একটা ভাই আছে। ওর একটা গার্লফ্রেন্ড আছে। ওরা ভিয়েনা’তে এক সঙ্গে থাকছে। বছরের এই সময়টায় তাই খুব একাকী মনে হয়।

আমি মেয়েটার কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম- আহা, মানুষের জীবনে কতো রকম কষ্ট’ই না আছে। শেষমেশ তাকে বলছিলাম
– তোমার যখন’ই খারাপ লাগবে, আমার কাছে চলে এসো। দুজনে মিলে আড্ডা দেয়া যাবে।

এরপর আমরা অনেক সময় এক সঙ্গে কাটিয়েছি। চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ও বাসা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় চলে যাওয়াতে আজকাল আর সেই অর্থে খুব একটা যোগাযোগ হচ্ছিলো না।

আমি বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দেখি এলিস দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা গাঢ় লিপস্টিক দিয়েছে। কানে বিশাল একটা দুল পড়েছে। চোখেও মনে হচ্ছে কিছু লাগিয়েছে। হাত দুটো পেছনে।
-হ্যাপি বার্থডে আমিনুল। এই দিনে রাত ১২ টার মাঝে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে? তোমাকে দিয়ে কিছু’ই হবে না!
মেয়েটা পেছন থেকে হাত বের করে ফুল দিয়েছে আমাকে। আমি খুব অবাক হয়েছি! কারন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজ আমার জন্মদিন! তবে, এমন একটা ভাব করলাম- এ আর এমন কি!
– তুমি এতো রাতে এমন সেজে গুজে কোথায় বের হয়েছ?
-কেন, তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে বের হয়েছি। কোন সমস্যা? এবার চল বাইরে হেঁটে বেড়াই, সেই সঙ্গে তোমার জন্মদিনের প্রথম প্রহর উদযাপন করি।

আমি ওভার কোট’টা পড়ে ওর সাথে বের হয়েছি। শহর’টা পুরো ঘুমিয়ে আছে। তাপমাত্রা হিমাংকের নিচে মাইনাস ৫। বেশ বাতাস বইছে। সেই সঙ্গে বড় দিন উপলক্ষে লাল-নীল বাতি। কোথাও কোন মানুষজন নেই।
সামনের রাস্তা পার হয়ে মূল রাস্তায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে পাশের আইরিশ পাব থেকে নানান বয়েসি মানুষজনের শব্দ ভেসে আসছে।
-চলো আইরিশ পাবে যাই। আজ তোমার জন্মদিন। একটু আনন্দ করা যাক।
-ঠিক আছে চলো

আলো-আধারি আইরিশ পাব’টা মনে হচ্ছে আজ খুব বেশি জমে উঠেছে। চারদিকে কেবল’ই হাসি’র শব্দ। বাম দিকের একদম কোনার টেবিলটায় মাঝ বয়েসি দুই নারী-পুরুষ এমন ভাবে শব্দ করে হেসে কথা বলছে; দেখে মনে হচ্ছে তাদের মনে হয় যাপিত জীবনে কোন দুঃখ নেই।

মাঝের টেবিলে কম বয়েসি তরুণ-তরুণী একটু পর পর বসছে আর দাঁড়াচ্ছে। যখন’ই দাঁড়াচ্ছে; চেষ্টা করছে একজন আরেকজন’কে চুম্বন করার। করেই বিশাল শব্দ করে হাসছে। এরপর বসে পড়ছে!
আমি আর এলিস ডান দিকের টেবিলটায় বসে কথা বলছি।

-আমিনুল, গত আট বছরে তোমার কোন জন্মদিনে আমি রাত ১২টার সময় হাজির হইনি এমন কী হয়েছে?
আমি খানিকটা চমকে গিয়েছি ওর কোথায়। আমার সত্যি’ই মনে ছিল না, মেয়াটা প্রতিটা জন্মদিনে রাত ১২টায় হাজির হয়েছে।

-আমিনুল, আট বছর আগে তুমি যখন আমাকে বলেছিলে- তোমার যখন’ই একা মনে হবে; চলে এসো। এরপর আমি তোমাকে অনেক ভাবে বিরক্ত করেছি। কখনো মাঝ রাতে হাজির হয়েছি। কখনো ভোর বেলায়। কখনো হঠাৎ করে ফোন করে বিরক্ত করেছি। কিন্তু তুমি কোন দিন বিরক্ত হওনি। সব সময় প্রাণ খুলে হাসি মুখে’ই আমার বিরক্তি গুলো সহ্য করেছ।

আমি খুব কঠিন সময় পার করছিলাম তখন। সেই সময় গুলো আমি অতিক্রম করেছি। আমার এখন সঙ্গী আছে। আশপাশে মানুষ আছে। আমি জানি একাকীত্বে’র কষ্ট। আমার মতো একজন মানুষের প্রতি যে মায়া তুমি দেখিয়েছ; সেটা ফেরত দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। অন্তত তোমার জন্মদিনে যেন কখনো একাকীত্ব এসে ভর না করে; তাই অনেক বছর আগে’ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যত দিন পারি, তোমার জন্মদিনের প্রথম প্রহরে তোমাকে শুভেচ্ছা জানাবো। মেয়েটার কথায় আমি সত্যি’ই অবাক হয়েছি। হিসেব করে দেখলাম সত্যি’ই সত্যি’ই মেয়েটা আমাকে গত আট বছরে এভাবে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে! পাব থেকে বের হয়ে মেয়েটার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এপার্টমেন্টে ফিরছি; হঠাৎ মনে হলো- জীবনে কতো মানুষের জন্য কতো কিছু করেছি। কই, তারা তো কোন দিন খোঁজ নিয়েও দেখেনি। আর এই রাশিয়ান মেয়েটা; যার জন্য সেই অর্থে কিছু’ই করেনি; কেবল মাঝে মাঝে ওর খারাপ লাগার সময় টুকু’তে ওকে সঙ্গ দিয়েছি; সেই মেয়েটা কিনা প্রতি বছর ঠিক ঠিক হাজির হচ্ছে শুভেচ্ছা জানাতে।

মাঝ রাত পার হয়ে প্রায় ভোর হবার সময় হয়ে এসছে। আমি মূল রাস্তায় চলে এসছি। দূর থেকে এখনও নানান বয়েসি মানুষের হাসির শব্দ ভেসে আসছে আইরিশ পাব থেকে। হঠাৎ মনে হলো- আচ্ছা, মানুষ গুলো কী সত্যি’ই এতো সুখি। নাকি এক রাতের জন্য স্রেফ সুখি হবার চেষ্টা করে যাচ্ছে?

ভোর হতে শুরু করেছে। আশপাশে দুই একটা গাড়ি’র শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সূর্যে’র আলো অবশ্য বছরের এই সময়টায় কখনোই উঠে না। ভোর হয় কিন্তু সূর্যের আলো’র দেখা পাওয়া যায় না। ছয়মাস এমন’ই থাকে। হঠাৎ মনে হলো- কিছু মানুষের জীবনটাও মনে হয় এমন। রাত পার হয়ে ভোর হয় কিন্তু আলো এসে আর দেখা দেয় না। হাজারো মানুষ এসে আশপাশে ভিড় করে। আবার সেই হাজারো মানুষের ভিড়েও একাকীত্বের শূন্যতা এসে ভর করে।

আমি দ্রুত পায়ে নিজের এপার্টমেন্টের দিকে ফিরছি। বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ছে। বছরের এই সময় তো তুষার পড়ার কথা, বৃষ্টি পড়ছে কেন? তাও আবার রীতিমত ঝড়ের বেগে বৃষ্টি। আশপাশের পরিবেশও মনে হয় জানান দিচ্ছে, সব কিছু নিয়ম মনে চলে না। হঠাৎ মনে হলো- আচ্ছা, এলিস যে প্রতি জন্মদিনে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছে; সেটা কেন আমার মনে থাকলো না?

বৃষ্টি’র গতি বাড়ছে। আমি দ্রুত পায়ে এপার্টমেন্টের দিকে ফিরছি। আচ্ছা, আজ না ফিরলে কেমন হয়? সব কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে; এমন তো নয়!

কাঁক ভেজা হয়ে যখন বাসায় ফিরছি, তখন মনে হলো- অনিয়মেরও নিয়ম থাকে। জন্মদিন প্রতি বছর ঠিক’ই এসে হাজির হয়। স্রেফ আশপাশের মানুষ গুলো বদলাতে থাকে। যে’ই মা প্রতিবছর সবার আগে রাত ১২টায় শুভেচ্ছা জানাত; সেই মা এখন পৃথিবীতেই নেই।

আমিনুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অস্ট্রিয়া। (ফেসবুক থেকে)

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2024
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: রায়তা-হোস্ট
tmnews71