কিয়াইকতিও প্যাগোডা মিয়ানমারের একটি শীর্ষস্থানীয় তীর্থস্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। এটি গোল্ডেন রক প্যাগোডা নামেও পরিচিত। এটি মিয়ানমার বা বার্মার ইয়াঙ্গুন শহর থেকে প্রায় ১৩০ মাইল বা ২১০ কিমি দূরে দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সোমরাজ্যে। রাজ্যের রাজধানী মাওলামিইন থেকে ১৪০ মিটার (৪৬০ ফুট) উত্তরে। এটি পূর্ব ইয়োমা পর্বতের পং-লং শৈলশিরায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার নয় ফুট বা এক হাজার একশ’ মিটার উঁচু কিয়াইকতিও পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। কিয়াইকতিওর পাদদেশে কিনপুন গ্রাম। সেখান থেকে এ প্যাগোডার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার বা প্রায় ১০ মাইল।
প্যাগোডাটি নির্মাণ করা হয় আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে। সোম ভাষায় ‘কিয়াইক’ অর্থ ‘প্যাগোডা’ ও ‘ইয়ো’ অর্থ ‘মাথায় বহন করা’ এবং ‘ইথি’ (সংস্কৃত ঋষি>পালি রিসি) অর্থ ‘ভিক্ষু’। সুতরাং ‘কিয়াইকতিও’ নামটির অর্থ দাঁড়ায় ‘ভিক্ষুর মাথায় বহন করা প্যাগোডা’। প্যাগোডাটির উচ্চতা সূচাগ্র চূড়াসহ মাত্র ২৪ ফুট। এটি দেখতে ভিক্ষুর মাথার মতো একটি ডিম্বাকার গ্রানাইট বোল্ডারের ওপর স্থাপিত, যার উচ্চতা ২৫ ফুট এবং বেড় ৫০ ফুট। বোল্ডারটি আবার মূল পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্ন একটি শিলার বহিঃপ্রান্তের ঈষৎ ঢালু স্থানে হেলানো অবস্থায় বসে আছে। বসে কি! বলা ভালো ঝুলে আছে। সোনার শিলা বা পাথর ও এর ভিত্তিশিলা পরস্পর আলাদা। কোনো নির্দিষ্ট কোণ থেকে দেখা হলে এ দু’টোর বিভাজন একেবারে স্পষ্ট দেখা যায়। শিলার ভিত্তি ঘিরে সোনার পাতায় একটি পদ্মের আকৃতি আঁকা হয়েছে।
ভিত্তিশিলার ওপর বোল্ডারটির অবস্খানই এই প্যাগোডার মূল বিশেষত্ব। সোনার শিলাটির দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেক এর ভিতের বাইরে। প্রকৃতির কোন গূঢ় ইঙ্গিতে শিলাটি এর ভিতকে নামমাত্র ছুঁয়ে এভাবে একপাশে ঝুঁকে আছে কে জানে? দেখলে মনে হয়, যে কোনো মুহূর্তেই এটি ফসকে গিয়ে গড়িয়ে গিরিখাদে পড়ে যাবে। অথচ বহু শতাব্দী ধরে এবং বেশ কয়েকটি প্রবল ভূমিকম্প সত্ত্বেও এটি কিভাবে দৃশ্যত মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অগ্রাহ্য করে এমন পতনোন্মুখ নাজুক অবস্খানে ভারসাম্য রক্ষা করে টিকে আছে, তা সত্যিই প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়।
লোকচক্ষুর সামনে এক জাজ্জ্বল্যমান অলৌকিক কীর্তি! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাছে যার কোনো উত্তর নেই। তবে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, প্যাগোডায় বুদ্ধের কেশধাতু সংরক্ষণের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। একটি জনশ্রুতি মতে, স্বর্ণশিলাটি বুদ্ধের একটি মাত্র কেশধাতুকে অবলম্বন করেই অটল-অবিচল রয়েছে।
জনশ্রুতি আছে মহাত্মা গৌতম বুদ্ধ আর এক ভ্রমণকালে এক ভিক্ষুকে বার কয়েকটি কেশধাতু দান করেন। ভিক্ষু সেগুলো তার চুলের গিঁটে লুকিয়ে রাখেন। পরে তিনি এটি রাজাকে দেন এবং তার নিজের মাথার আকৃতির একটি বোল্ডারের ওপর একটি প্যাগোডা নির্মাণ করে তাতে এ কেশধাতু সংরক্ষণের অনুরোধ করেন। রাজা তার অলৌকিক ক্ষমতা বলে সাগরে প্রার্থিত বোল্ডারটি খুঁজে পান।
তিনি স্বর্গরাজের সহায়তায় বোল্ডারটি স্থাপনের যথার্থ স্থান নির্ধারণ করে প্যাগোডা নির্মাণ করেন এবং বুদ্ধের কেশধাতু সংরক্ষণ করেন। পাথর পরিবহণে ব্যবহৃত নৌকাটি পাথরে পরিণত হয়। এটি স্বর্ণশিলা থেকে প্রায় তিনশ’ মিটার (৯৮০ ফুট) অবস্খিত। এটি কিওকথানবান প্যাগোডা বা স্তূপ নামে পরিচিত। আক্ষরিক অর্থ: পাথরের নৌকা স্তূপ।
এ প্যাগোডা বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আকারে ছোট হলেও এটি মিয়ানমারের অন্যতম শ্রদ্ধেয় ও মর্যাদাবান প্যাগোডা। কিয়াইকতিও পাহাড় চূড়ার এ প্যাগোডাটিকে শ্বেদগন প্যাগোডা এবং মহামুনি প্যাগোডার পরে বার্মার তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসাবে গণ্য করা হয়। আসিয়ান দেশগুলোর পর্যটন কর্তৃপক্ষের সাম্প্রতিক এক প্রকাশনায় এ প্যাগোডাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বিস্ময় হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ত্রিপাদভাইজার ডট কম এটিকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে বিস্ময়কর স্থান’ হিসাবে রেটিং করেছে। মনে করা হয়, এই স্বর্ণশিলা এক ঝলক দেখলেই যে কারো মনে পলকেই বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের স্পৃহা জাগ্রত হয়।
এ প্যাগোডার প্রধান তীর্থ মৌসুম হলো নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। এসময় ভোর থেকে সন্ধ্যা অব্দি স্বর্ণশিলাটি নানা রঙে-রূপে ঝলমল করে। বিশেষ করে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এটি অপরূপ হয়ে ওঠে। পুরো পাহাড়ে একটি ধর্মীয় আবহের সৃষ্টি হয়। তীর্থযাত্রীদের মন্ত্রোচ্চারণে মন্দির চত্বর গমগম করতে থাকে। সারা রাত ধরে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, ধ্যান ও বুদ্ধের কাছে নৈবেদ্য প্রদান চলতে থাকে। পুরুষরা একটি ছোট সেতু দিয়ে গভীর ফাটল পেরিয়ে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্বর্ণশিলার পিঠে বর্গাকৃতির সোনার পাত লাগিয়ে দেন। তবে নারীদের পাথর স্পর্শ করার অনুমতি নেই। প্যাগোডা কর্তৃপক্ষ পরে সোনার পাতগুলো গলিয়ে বোল্ডারে লেপে দেন। যার ফলে কালক্রমে বোল্ডারটি সম্পূর্ণ সোনালি রঙ ধারণ করেছে।
মার্চ মাসে তবাংয়ের পূর্ণিমায় মন্দিরে আসা তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। এদিন প্যাগোডা প্রাঙ্গনে ভগবান বুদ্ধকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন হিসাবে নব্বই হাজার মোমবাতি জ্বালানো হয়। প্যাগোডায় আসা ভক্তরা বুদ্ধকে ফলমূল, খাবার ও ধূপকাঠি অর্ঘ্য দেন। মিয়ানমারের সমস্ত অঞ্চল থেকে পূন্যার্থীরা এ প্যাগোডায় তীর্থ করতে আসেন। স্বল্পসংখ্যক বিদেশি পর্যটকও প্রতিবছর স্বর্ণশিলা ঝুলন্ত প্যাগোডা দেখতে আসেন। কিনপুন থেকে পায়ে হেঁটে বা বাসে যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে চার ঘণ্টা আর গাড়িতে গেলে আধা ঘণ্টা সময় লাগে।