বিষয়টি লজ্জার। অক্ষমতার শুধু নয়, অনুধাবনেরও। নিছক সমালোচনারও নয়, স্বাস্থ্য সেবা খাতে আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতার চিত্র হলেও তা আত্মপ্রস্তুতির জন্যই সামনে নিয়ে আসা।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর প্রায় আড়াই মাসে আমরা। অনেক তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক হলো। কিন্তু আমরা এগুলাম কতটুকু? নাকি এখনো সেই তিমিরে! ‘যেই লাউ সেই কদু’?
চট্টগ্রামের একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের করুণ আহাজারির প্রসঙ্গ এনে বলা যাক। ডা. এস এম লুৎফুল কবির শিমুল। করোনা চিকিৎসায় সরকার নির্দিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট। তার ভাগ্য বিড়ম্বনার মতোই যেন এখনো সারা দেশের করোনা চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা!
জীবন ঝুঁকি নিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে টানা ৭ দিন করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন শিমুল। নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিনের আইসোলেশন শেষে ৬ দিনের জন্য পরিবারে ফিরে যান তিনি। এরমধ্যে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিসের রোগী এই চিকিৎসকের জ্বর, সর্দি কাশি, শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। যেই হাসপাতালটিতে ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, সেই হাসপাতালেই আবার পরিবার ছেড়ে নিজের চিকিৎসার জন্য ছুটে যান ডা. শিমুল। ভর্তি হতে চান। কিন্তু করোনা উপসর্গ দেখা দিলেই ‘টেস্টের রিপোর্ট ছাড়া সরকার নির্ধারিত হাসপাতলে কোনো ‘নন কোভিড’ রোগী ভর্তি করানো সম্ভব না’ বলে তাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো। অতঃপর তিনি ছুটে যান চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত ম্যাক্স হাসপাতালে। তিনি নিজেই হাসপাতালটির অন্যতম পরিচালকও। কিন্তু করোনা উপসর্গে ম্যাক্স কর্তৃপক্ষও তাঁকে ভর্তি করাল না। অতঃপর নিরুপায় হয়ে ছুটে যান আরেকটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে। ‘ইসলামিয়া হাসপাতাল’ নামের এই স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রেও এই চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। সেখানেও ভর্তি হতে চেয়ে ঠিক একই কারণে পারেননি।
জ্বর সর্দি শ্বাসকষ্টের সাথে বুকে ব্যাথায় আহাজারী করতে থাকা এই চিকিৎসক সরকারি-বেসরকারি ৩টি হাসপাতালেই সেবা না পেয়ে অতঃপর দুটি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ শঙ্কায় নিজ বাসায় নিজস্ব চিকিৎসার আশ্রয় নেন! ৪৮ ঘণ্টা কাতরাতে থাকেন বাসায়। এর আগে একতরফা করোনা পরীক্ষায় তার ‘নেগেটিভ’ আসে! ডা. বন্ধুদের পরামর্শে ফের পরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই সিটি স্ক্যানে ‘কোভিড-১৯’ বা করোনার আলামত পাওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত করোনা পজিটিভ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আগেই সহযোদ্ধা চিকিৎসক নেতাদের জোর প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের একটি আলাদা বেডে ঠাঁই জুটে এই চিকিৎসকের। এই হলো চট্টগ্রামের করোনা চিকিৎসার সাম্প্রতিক অবস্থা।
যে চিকিৎসক নিজের পরিবার এর মায়া ছেড়ে নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে অন্যের সেবা দিয়েছেন, সেই ফ্রন্টলাইনারকে সরকারি-বেসরকারি কোন হাসপাতালেই ভর্তির সুযোগ না পেয়ে অক্সিজেন কিনে নিজের বাসায় আহাজারি করতে হয়েছে দু’দিন! একজন চিকিৎসকের চিকিৎসা না পাওয়ার- অসহায়ত্বের এই কেস স্ট্যাডি এরকম ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কত বেশি অসহায়ত্ব হতে পারে, তা যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মত।
এক হতভাগা ডা. শিমুলের এই দশা করোনা সময়ে বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ এর মত অত্যধিক বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর শহরের চিকিৎসাব্যবস্থা কিংবা আড়াই মাসের প্রস্তুতি চিত্র বোঝা যায়।
প্রশ্ন উঠে, করোনা লক্ষণ পেলেও পরীক্ষার রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি না করানোতে শিমুলের মতো শত শত রোগীর অবস্থা তাহলে কেমন? তারাও কী এমন আহাজারি করছেন?
প্রশ্ন উঠে এও, চিকিৎসাটা কি করোনা ‘টেস্ট রিপোর্টে’র হবে, নাকি সমূহ মৃত্যু আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ও ভোগান্তির শিকার করোনা লক্ষণগ্রস্ত রোগীর হবে? তাহলে কি করোনা পজিটিভ চিহ্নিত না হওয়া পর্যন্ত লক্ষণগ্রস্তদের কোনো সরকারি বেসরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন ইউনিট নেই চট্টগ্রামে ? সারা দেশের পরিস্থিতিটা তাহলে কেমন?
হ্যাঁ, অবস্থাটি এমনি ভয়াবহ। চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় চার কোটি মানুষের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের স্থান চট্টগ্রাম শহরের কোথাও এমন ‘অফিসিয়াল আইসোলেশন বা অফিসিয়াল কোয়ারেন্টাইন’ ইউনিট নেই।
তাহলে হুড়মুড়িয়ে বাড়তে থাকা করোনা সন্দিগ্ধ বা লক্ষণগ্রস্তরা ঝুঁকিহীন সেবা নিতে যাবেন কোথায়? ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ বা ‘হোম আইসোলেশন’ কি নিরাপদ? হোম কোয়ারেন্টিন-আইসোলেশনে পৃথক ওয়াশরুমসহ সতর্কতার সবকটি মাত্রা নিশ্চিত করা যে গুটিকয় সচেতন উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত ছাড়া অন্যদের বেশিরভাগেরই সম্ভব নয়, তা সবাই এক বাক্যেই স্বীকার করবেন।
চিকিৎসক বন্ধুরা অনেকেই জানালেন, চট্টগ্রামের কোথাও ‘বিশেষায়িত আইসোলেশন’ বা ‘অফিশিয়াল কোয়ারেন্টিন ইউনিট বা ওয়ার্ড’ গঠনের কোন উদ্যোগই নেওয়া হয়নি এখনো । যে কারণে ইতোপূর্বে যাদের করোনা চিকিৎসার জন্য সরকারি নির্দিষ্ট ২টি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে করোনা পজিটিভ রোগী ও সন্দিগ্ধদের পাশাপাশি রাখা হয়েছে। প্রথমদিকে সন্ধিগ্ধ বা লক্ষণগ্রস্তদের ভর্তি করা হলেও এখন টেস্ট রিপোর্টে করোনা সনাক্ত হওয়ার আগে ভর্তি করা হচ্ছে না।
বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিত একমাত্র ফিল্ড হাসপাতালটিরও অভিন্ন চিত্র। সেখানটাতেও যেন মানুষের আগ্রহ বেশি। রোগীর চাপে ঠাঁই নেই দশা হতে চলেছে।
দায়িত্বশীল নির্ভরযোগ্য চিকিৎসক বন্ধুরা জানান, করোনা আক্রান্ত ৭৬ শতাংশ রোগীই এখনো বাসায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। করোনা পজিটিভ ও সন্দিগ্ধ রোগীর চাপ এতই বাড়ছে যে, চট্টগ্রামে কোন হাসপাতালেই আলাদা আইসোলেশন ইউনিট না থাকায় দু-একদিনের মধ্যে আর নতুন করে করোনা পজিটিভ রোগীও ভর্তি করানো যাবে না । ইতোমধ্যেই মারাত্মক জটিল পরিস্থিতি না হলে উপায়ান্তর না দেখে বাসায় চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। রোগীর চাপ আরও বাড়লে বাড়তি চাপের বিপরীতে ভর্তি সক্ষমতার অভাবে আক্রান্ত ও সন্দিগ্ধ রোগীদের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর আশঙ্কাও রয়েছে। আর এমনটি হলে সামাজিক সংক্রমণের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।
এদিকে সম্ভাবনার চিত্রটি যদি সর্