বেলজিয়ামের ব্রাসেলস থেকে হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট গিয়েছিলাম ইউরো ট্রেনে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইউরোপে আমার প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। সন্ধ্যাবেলায় ট্রেন ব্রাসেলস ছেড়ে সকাল সাড়ে সাতটায় পৌঁছে ছিল বুদাপেস্ট। কেলেতি রেলস্টেশনে নেমে প্রথম দেখায় বুদাপেস্টের প্রেমে পড়ে যাই। কি সুন্দর নিরিবিলি শহর। চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কেলেতি স্টেশনটি পূর্ব ইউরোপের সবচেয়ে প্রাচীন ও সুন্দর। দেড়শত বছরের পুরানো রেলস্টেশনটি চমৎকার গোছানো। স্টেশনটির গঠন এমনই যে ছাদের ওপরের অংশ পুরোটাই খোলামেলা। সূর্যের আলোয় স্টেশনের ভেতর সারাক্ষণ আলোকিত থাকে।
স্টেশন থেকে হাঁটা দূরত্বে সিটিপার্ক। এখানকার এন্ড্রেসি হোটেলই হচ্ছে আমার আগামী ৪৮ ঘণ্টার আবাসস্থল। রেটিংবিহীন মাঝারিমানের হোটেল। খুব সস্তায় দুইদিনের রুম বুকিং দেয়া হয়েছে ৬০ ইউরোতে। আমার রুম পেয়েছি তিনতলায়। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নীচে যাই। হোটেলের লবি লাগায়ো ছোট রেস্তোরাঁ। ডিম পোচ, জেলি ব্রেড ও কফিতে ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমে ঢুকে বিছানায় চলে আসি। রাতে ট্রেনে ভাল ঘুম হয়নি। কিছুসময় গড়িয়ে না নিলে শহর ঘুরে দেখার এনার্জি থাকবে না।
বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হবার অনেক আগে কৈশোরে হাঙ্গেরির নাম জানা হয় ‘গ্লোব পাবলিকেশন্সে’র বিশ্বের ডায়েরি পড়ে। সোভিয়েতের উদয়ন ম্যাগাজিনে পেতাম বলকান রাষ্ট্রগুলোর ছবি। সেইসময় সাদা বরফে ঢাকা তুন্দ্রাঞ্চলের সাথে আমার জানাশোনা হয়ে যায় ।
বলকান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে হাঙ্গেরি প্রথম ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ১৫০ বছর শাসিত হয় হাঙ্গেরি। বুদাপেস্ট হচ্ছে রাজধানী ও প্রধান শহর। এখনো এ শহরে অটোমান সাম্রাজ্যের কিছু স্মৃতি রয়েছে, স্থাপনায় তুর্কি ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। বলকান অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্যমণ্ডিত সবচেয়ে সুন্দর নগরী হচ্ছে বুদাপেস্ট।
বুদাপেস্ট হচ্ছে রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল। শুধু তাই নয় ইউরোপের অন্যতম সুন্দর শহর। ১৮৭৩ সালে বুদাপেস্ট শহরের পত্তন হয়। দানিয়ুব নদী শহরটিকে দুইভাগ করেছে। আবার চেইনব্রিজ পশ্চিমে বুদা এবং পূর্বের পেস্টকে সংযুক্ত করেছে।
বেলা এগারোটায় রুম থেকে বের হয়ে রিসিপশন থেকে প্রথমেই সংগ্রহ করি বুদাপেস্টের ম্যাপ ও গাইডবুক। এই দু’টি জিনিস সাথে থাকলে যে কোন শহর ঘোরা সহজ। ম্যাপ ও ট্যুরগাইডবুক উল্টেপাল্টে দেখে মনস্থির করি কোথায় কোথায় যাওয়া যাবে।
যে কোন নতুন শহরে পা দিয়ে আমার প্রথম যাওয়া হয় ওল্ডটাউন। আসলে ওল্ডটাউনে পরিচিত হওয়া যায় একটা শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাধারণ মানুষের রুচি ও সংস্কৃতির সাথে।
প্রথমে ট্রামে চেপে যাই সেইন্ট স্টিফেন্স বাসিলিয়া। অদ্ভুত সুন্দর দর্শনীয় স্থান। যারা পুরানো শহর দেখতে আগ্রহী, ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসন্ধানী তাদের জন্য সেইন্ট স্টিফেন বাসিলিয়া হছে পারফেক্ট স্থান। কয়েক শত বছরের পুরানো ভবন, পাথুরে পথ চিরে যাওয়া ট্রাম, আলো আধারির রেস্তোরাঁ, কফিশপ, হাঁটতে হাঁটতে ভেসে আসে পিয়ানো বা ভায়োলিনের সুরের মূর্ছনা, বহুজাতিক পর্যটকদের ছবি তোলার হিড়িক বেশ ভালোই লাগে।
মানুষদের বেশভূষা, জীবনযাপন যতটুকু চোখে পড়লো তাতে মনে হচ্ছে বেশ কমখরচের শহর বুদাপেস্ট।
ম্যাপ দেখে দেখে পথঘাট বের করে ফেলি। যানবাহন হিসেবে ট্রাম হচ্ছে বেস্ট। সেইন্ট বাসিলিয়া থেকে হিরো’স স্কয়ার এবং মিলেনিয়াম পাতাল রেলপথ দেখি। মিলেনিয়াম পাতাল রেলপথ বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন পাতাল রেলপথ। এটি ১৮৯৪ সালে চালু হয়েছে। স্টেশনের ভেতর-বাহির সবস্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও যত্নের ছাপ। হিরোস স্কয়ারের চারপাশে রয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ছড়াছড়ি। জাদুঘর, চারুকলা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি, অর্কেস্ট্রা হল ও থিয়েটার থেকে শুরু করে এখানে কি নেই!
ঘুরতে ঘুরতে ক্ষুধা লাগে। দুপুরও হয়ে গেছে। সস্তা একটা রেস্তোরাঁয় প্লেইন রুটি, চিকেন, গুলাস স্যুপ, সালাদ দিয়ে লাঞ্চ সেরে ফেলি। গরুর মাংসের এই ঘন গুলাস স্যুপ সত্যিই অতুলনীয়। এটা হাঙ্গেরির ঐতিহ্যবাহী খাবার। লাঞ্চ শেষে ট্রাম চেপে যাই পার্লামেন্ট ভবন দেখতে।
দানিয়ুব নদীর তীরে হাঙ্গেরির সংসদ ভবন। গোথিক স্থাপত্যশৈলিতে ভবনটি দৈর্ঘ্য আয়তনে অনেক বড়। ১৮৯৪ সালে নির্মিত ভবনের বাহিরে অপূর্ব কারুকাজ দেখে মন ভরে না। ভেতরে ঢোকার জন্য আকুতি বেড়ে যাওয়ায় ১০ ইউরোতে টিকেট কিনে ঢুকে পড়ি।
আমার হোটেলের রিসেপিশনের মেয়েটি বলেছিল, সংসদ ভবন দেখতে প্রতিদিনই নাকি দর্শনার্থীর উপচেপড়া ভীড় থাকে। টিকেট থাকার পরও সবাই ভেতরে ঢুকতে পারে না। একথা মনে পড়ায় আমি রিস্ক নেই না। কোনরকম ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাই। প্রতিদিন স্বল্পসংখ্যক দর্শনার্থীকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয় বলে প্রবেশপথের সামনে হুল্লোড় বেশি। আমার ভাগ্য ভাল, ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে পেরেছি।
হাঙ্গেরিয় সংসদ ভবন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সংসদ ভবন। ভবনটি ১৮৯৪ সালে নির্মিত হয়েছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের কথা ভাবনায় রেখে। ভেতরে প্রবেশের পর নিজের মতন ঘুরে দেখার কোন সুযোগ নেই। একজন গাইড ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান ও বর্ণনা দেন। ছবি তোলাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
সংসদের অধিবেশন কক্ষের সকল আসবাবপত্র কাঠের তৈরি। মূল অধিবেশন কক্ষ ছাড়াও সকল কক্ষের খিলানে ঝোলানো রয়েছে হাঙ্গেরির শ্রমজীবী মানুষের ছোট ছোট মূর্তি। গাইড জানায়, এই মূর্তিগুলো বানানো হয়েছে আইনপ্রণেতারা যেন সংসদে ঢুকে ভুলে না যান সাধারণ মানুষের কথা। মূর্তিগুলোর সবই কামার, ছুঁতোর, ধোপা, কাঠুরে, কৃষক ও গোয়ালাদের। সারা সংসদভবন জুড়ে তাদের উজ্জল উপস্থিতি জানান দেয় ”আমরাই তোমাদের এখানে পাঠিয়েছি, আমাদের ভাগ্য নিয়ে তোমরা খেলো না।”
ভবনের ঠিক মধ্যখানের বিশাল কক্ষটিতে রয়েছে রাজমুকুট। বারোশ শতাব্দী যাবত হাঙ্গেরির প্রায় পঞ্চাশজন রাজা এই মুকুটটি পরেছেন। বেশ ক’বার চুরিও হয়েছে । সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিরা মুকুটটি নিয়ে যায়। পরে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে উদ্ধার করে আমেরিকা মুকুটটি নিয়ে যায় নিউইয়র্কে। তিনদশক পর হাঙ্গেরির ঐতিহ্য এই রাজমুকুটটি ১৯৭৮ সালে আমেরিকা ফিরিয়ে দেয় বন্ধুত্বের নির্দশন হিসেবে।
এতো বিশাল ভবন ঘুরে কিছুটা ক্লান্তি পায়। একটু বিশ্রামের জন্য দানিয়ুব নদীর তীরে এসে ছোট একটা বেঞ্চিতে বসি। বেঞ্চি থেকে সামান্য দূরে নদীর তীরের একটি অংশে লোহার তৈরি অসংখ্য জুতো, সেন্ডেল, পেন্সিল হিলের ভাস্কর্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরির উগ্র ডানপন্থী ও জার্মান নাজি বাহিনী ইহুদিদের ধরে নিয়ে আসতো। নির্মম নির্যাতনের পর বন্দুকের নলের মুখে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার মুহূর্তে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার নিরীহ ইহুদিদের এভাবে হত্যা করা হয়েছে ।
বর্বরোচিত সেই হত্যাকাণ্ডকে মনে করিয়ে দেয় দানিয়ুব নদীর এই তীর। ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা জুতাগুলোর ওপর ফুল দিয়ে স্মরণ করে বিভীষিকাময় নৃশংস হত্যাকাণ্ড।
বুদাপেস্ট কিন্তু দুইটি শহরের মিলিত নাম। দানিয়ুব নদীর পূর্বপাড়ের বুদা এবং পশ্চিমতীরের পেস্ট মিলে একটি শহর। বুদা হচ্ছে পাহাড়ি আর পেস্ট হচ্ছে সমতল এলাকা। এই দুই শহরকে সংযুক্ত করেছে চেইন ব্রিজ। দানিয়ুব নদীর ওপর যে আটটি ব্রিজ রয়েছে তার মধ্যে চেইনব্রিজ সবচেয়ে পুরানো। আমি হেঁটেই ব্রিজ পার হয়ে পেস্ট শহরে যাই। সাধারণ যানবাহনের পাশাপাশি শত বছরের পুরানো হলুদ ট্রাম ব্রিজের ওপর চলাচল করতে দেখা যায়।
ট্রাম চেপে শহরের শেষ প্রান্তে সিতাডেল পাহাড়ের পাদদেশে নেমে পড়ি । সবুজ প্রকৃতির সাথে পুরানো বাড়িঘর। গাছপালায় চমৎকার ছোট শহর। এখানে একদা কবিগুরু এসেছিলেন। তার স্মৃতি রয়েছে হোটেল গ্যালায়েতে।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বুদা ক্যাসেল দেখতে গিয়ে আমার হাত পা ভেঙে আসে ক্লান্তিতে। এই বুদা ক্যাসেল হচ্ছে হাঙ্গেরির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভবন। কয়েক শত বছরের পুরানো বিশাল ক্যাসেলের স্থাপত্যশৈলি সহজে দৃষ্টি কেঁড়ে নেয়। বিনা বাধায় ক্যাসেলের খুব কাছে চলে যাওয়া যায়। নিরাপত্তারক্ষীদের তেমন কড়াকড়ি বিধিনিষেধ জারি করতে দেখি নাই। বরং আমার মতন আরো দু’চারজন দর্শনার্থীকে হেসে অভ্যর্থনা জানালো। ভাবখানা এরকম ‘দেখো আমাদের এক সময়ের রাজপ্রসাদ।’
দূর থেকে দেখি বুদা ক্যাসেল। যার পরতে পরতে রয়েছে যেন ইতিহাসের গন্ধ। বিভিন্ন রাজার তৈরি করা বিভিন্ন স্থাপনাগুলো মুগ্ধ করে।
পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো পেস্ট শহরটি একনজরে দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ লাল টালির। বিল্ডিংগুলোর ফাঁক ফোকড় দিয়ে মাথাতুলে দাঁড়ানো গাছের সবুজ। কি অপূর্ব মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য বিমোহিত করে রাখে দর্শনার্থীদের ।
রোদে বেশি হাঁটাহাঁটি হলে আমার মাইগ্রেনের অসহ্য পেইন শুরু হয়ে যায়। চোখে মুখে অন্ধকার দেখি। ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যাবেলা পাহাড়ের ওপর থেকে আলো ঝলমলে পেস্ট শহর দেখা। কিন্তু মাইগ্রেন পেইনের কারণে বিকেলেই হোটেলে ফিরে আসতে হলো। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে রুমের ভারি পর্দা টেনে আলো নিভিয়ে অবেলায় ঘুমাতে বাধ্য হই।
সেই ঘুম ভাঙলো পরেরদিন সকাল সাতটায়। ন্যাচারালি কখনোই আমার সাত/আট ঘণ্টা একটানা ঘুম হয় না। অনেকদিন পর এরকম টানা ঘুম হলো। সাত সকালে ফ্রেশ হতেই শরীর মন দু’টো বেশ চাংগা লাগছে।
হোটেলের দেয়া ব্রেকফাস্ট খেয়ে শহর দেখতে বের হয়ে যাই। বুদাপেস্ট দেখার জন্য হাতে সময় আছে মাত্র ৯ ঘণ্টার মতন। আসলে এতো অল্প সময়ে ঐতিহাসিক একটি শহর দেখা সম্ভব না। কিন্তু উপায় নেই সন্ধ্যার ট্রেনে আমাকে ফিরতে হবে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায়। সেখানে একরাত থেকে যেতে হবে ক্রোয়েশিয়া। তারপর প্যারিস হয়ে দেশে ফিরবো। এ যেন হানড্রেড মিটার দৌড়ের মতন। দৌড়াতে দৌড়াতে দু’পাশে যা দেখতে পারো দেখে নাও!
আন্দ্রেসি এভিনিউর ফুটপাতে নেমে মনে হলো প্যারিসের কোন এভিনিউতে হাঁটছি। চওড়া রাস্তা। মাঝখানে আইল্যান্ড। ফুটপাতের পাশে ফুলের বাগান।
আমি গুগল ঘেঁটে বের করি, কি দেখা যাবে স্বল্প সময়ে। নেট ঘাটতে অবাক হই, এই পথের পাশের অনেক বাড়িঘর আছে, যেখানে কয়েক দশক ধরে গুপ্ত পুলিশের ঘাঁটি ছিল। সরকার বিরোধীদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। গুগুল ম্যাপ করে এমন একটি ভবনের সামনে এসে দাঁড়াই। সাদামাটা শ্রীহীন পুরানো বিল্ডিং। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই ভবনের ভেতর কত শত মানুষকে নির্যাতন করে মারা হয়েছে। স্থানীয়রা এসব ভবনগুলো ঘৃণার চোখে দেখেন। চলতি পথের অনেক ক্রোধান্বিত মানুষকে দেখি পাঁচিলে থুতু ছিটিয়ে ঘৃণা প্রকাশ করতে।
বুদাপেস্টকে অনেকে গির্জার নগরী বলেন। কিছুদূর পরপর গির্জা চোখে পড়ে। অর্থোডক্স ক্যাথেলিক, ব্যাপটিস্টদের পাশাপাশি কয়েকটি সিনাগগ চোখে পড়ে। সিনাগগ হচ্ছে ইহুদিদের ধর্মীয় উপসনালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক ইহুদি হাঙ্গেরি ছেড়ে চলে যায়। তারপরও বুদাপেস্টে তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটু হেঁটে গেলে চোখে পড়ে হাঁটু পর্যন্ত কালো ওভারকোট, কানের দু’পাশে ঝুলে থাকা বেনীর লম্বা চুল, মাথার মাঝখানে ছোট টুপি পরিহিত গোড়া ইহুদিদের।
হেঁটে হেঁটে আন্দ্রেসি এভিনিউ পার হয়ে চলে আসি দহানি স্ট্রিট। পুরানো বিল্ডিং, গীর্জা, সিনাগিগের সহাবস্থান। চলতি পথের দু’পাশে ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, বিপণি বিতান। একটা ক্যাফে শপে ঢুকে কড়া কফি ‘এস্প্রেসো’ ও ক্রোসা নেই। আসলে কফি নেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। কফিপান করতে করতে সাধারণ মানুষকে কাছ থেকে দেখা ও জানা। অলমোস্ট নাইনটি নাইন পার্সেন্ট হাঙ্গেরিয়ানরা সহজ সরল। একদম সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। পোশাক-আশাকে, খাওয়া-দাওয়ায় তাদের কোন আড়ম্বরতা নেই। হাঙ্গেরিয়ানদের মধ্যে খ্রিস্টীয় ধর্মের অনুসারীর সংখ্যাই বেশি।
বাস, রেল, ট্রাম ও শাটল ট্রেনের পাশাপাশি ইয়েলো ট্যাক্সি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাহন। কোনও মিটার নেই, তাই চালকরা নিজেরাই ভাড়া নির্ধারণ করেন। আন্দ্রেসি হতে হিরোস স্কয়ারের ভাড়া কি রকম হতে পারে আমার জানা ছিল না। কিন্তু ড্রাইভিং টাইম হিসেবে মিনিট দশ লেগেছে। সেই অর্থে ট্যাক্সি ফেয়ার সর্বোচ্চ কত হতে পারে, ধারণা করি ১০ ইউরো। কিন্তু ট্যাক্সি চালক চাইলো ২০ ইউরো!
হিরোস স্কয়ারে নেমে ঢুকে পড়ি মিউজিয়ামে। এখানকার মিউজিয়ামগুলো শিল্পকর্ম ও সংগ্রহের জন্য ব্যাপকভাবে সারাবিশ্বে পরিচিত। বেশিরভাগ মিউজিয়াম হিরো’স স্কয়ারে অবস্থিত। মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে যাই মিলেনিয়াম স্টেশন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টেশনগুলোর মধ্যে এ স্টেশনটি অন্যতম। প্রতিদিন সারা ইউরোপ থেকে অসংখ্য ট্রেন যাতায়াত করে। সারাক্ষণ নানান দেশের, ভাষার, বর্ণের মানুষজন গিজগিজ করে। ঘুরে ঘুরে আমি মানুষ দেখি। দেখি তাদের আচার-আচরণ। বোঝার চেষ্টা করি তাদের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। আমার কাছে পথেঘাটে মানুষ দেখার আনন্দই আলাদা।
চেক আউটের জন্য হোটেলে যখন ফিরে আসি তখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। সন্ধ্যা সাতটায় ইউরোট্রেনে যাব সোফিয়া। শাওয়ার নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নেই পরবর্তী গন্তব্যের জন্য।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)