করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার হেনস্থার শিকার হন পদে পদে। এবার তেমনি এক ঘটনা ঘটল কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলায়। করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতের স্ত্রীকে বাড়িতে বসতে একটা চেয়ারও দেননি বাবা-মা। জানাযা দাফনে আসেনি ভাইয়েরা। মোবাইল ফোনের আলোয় লাশ দাফন করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
মৃত অহিদুর রহমান (৩৮) দেবিদ্বার কুরুইন গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে। দাফনের পর এ নিয়ে বুধবার পরিবার ও স্বজনদের অমানবিকতা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু কাউসার অনিক। তা নিয়ে জেলায় আলোচনার সৃষ্টি হয়।
মৃতের স্ত্রী নুসরাত জাহান নিপা তার স্বামীর চিকিৎসা ও দাফনের করুণ কাহীনির কথা জানান এ প্রতিবেদককে, তার ভাষায়, তার স্বামী ওষুধ কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। তারা থাকেন নগরীর রেইসকোর্স কাঠেরপুল এলাকায়। ছয়-সাত দিন থেকে জ্বর। আইইডিসিআর-এর নম্বরে যোগাযোগ করেন নমুনা নিতে। কিন্তু তারা ফোন ধরে না। ধরলেও বলে কুমিল্লায় যোগাযোগ করতে। সিটি করপোরেশনে যোগাযোগ করতে। সেখানে ফোন দিলে জানায়, যারা পরীক্ষা করতো তাদের একজনও আক্রান্ত। কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েও ব্যর্থ হয়। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে জানায় নমুনার জন্য ভর্তি হতে হবে। এভাবে ঘুরাঘুরি করতে করতে সোমবার রাতে তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। মঙ্গলবার সকালে ৯৯৯ নম্বরে কল দেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক ৩ কিলোমিটার কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ যেতে দাবি করেন ১০ হাজার টাকা। পরে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করেন। সেটির চালক চান পাঁচ হাজার। সাড়ে তিন হাজার টাকায় রাজি করান। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে ছয় তলায় বেডে শোয়ানোর পর তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার পর একজন নার্স আসেন। পরে ক্যানোলা দিয়ে ইনজেকশন দেন, কিন্তু তা আর শরীরের ভেতরে যায় না। এরপর ওই অ্যাম্বুলেন্সেই মৃতের বাবার বাড়ি দেবিদ্বারে যান। সেখানে সন্ধ্যায় পৌঁছানোর পর ওই বাড়ির লোকজন বলে অ্যাম্বুলেন্সের দরজা না খুলতে। তিনি স্বামীর লাশ নিয়ে একা অ্যাম্বুলেন্সে বসে থাকেন। অন্যদিকে ভাবতে থাকেন তার বাসায় ছয় ও চার বছরের দুই ছেলে ও এক বছরের মেয়ে রয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে এলেও বসতে কেউ একজন চেয়ার চাইতে গেলে তাও দেওয়া হয়নি। ওই বাড়ির এক ব্যক্তি লাশ এখানে দাফন না করার জন্য বলেন। সন্তানের লাশ দেখতে তার মা-বাবা কেউ আসেননি। জানাযায় কোনও ভাই আসেননি। আড়াই ঘণ্টা পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে দাফনের ব্যবস্থা করেন। তিনি ওই অ্যাম্বুলেন্সে ফিরে আসেন। অ্যাম্বুলেন্স চালক দাবি করেন ১৫ হাজার টাকা। অনুনয় করে তাকে ১২ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন,তার স্বামী উপযুক্ত চিকিৎসা পায়নি। শেষ বিদায়ের সময় পায়নি স্বজনদের সম্মান।
উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু কাউসার অনিক বলেন, অহিদুর রহমানের লাশটি কবরে নামাতে আমাদের একটি কাপড়ের দরকার পড়ল। তার পরিবারের কাছে চাইলাম, কেউই দিতে এগিয়ে এল না। এক মহিলার একটি পুরনো ওড়না দিলেন। রাত তখন ৯টা পেরিয়ে। অহিদের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমরা কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগ ওরা ৪১ জনের টিম লাশ দাফনের জন্য তার বাড়িতে গেলাম। অহিদের বাড়ি গিয়ে যা দেখলাম, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা ভুলতে পারব না! অহিদের বাড়ির সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে খোঁজ করে কাউকে পেলাম না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, লাশ কোথায়? ড্রাইভার ইশারায় দেখিয়ে দিলেন। অ্যাম্বুলেন্সে পলিথিন মোড়ানো কাগজে পড়ে আছে। আমরা অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ ধরাধরি করে নামালাম।
তিনি বলেন, লাশের মালিক খুঁজতে গিয়ে কিছু দূর দেখলাম অন্ধকারে এক মহিলা বসে কাঁদছেন। জানতে পারলাম তিনি মৃত অহিদের স্ত্রী। স্বামী করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ায় তাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অহিদের ভাইদের খোঁজ নিয়ে জানলাম ওরা অদৃশ্য। মা, বোনদের কোনও আলামত পেলাম না। কেউ লাশের পাশে আসছেন না। প্রতিবেশী সবার দরজা বন্ধ। ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যানকে খোঁজ করেও পাওয়া গেল না। স্থানীয় একজন প্রভাবশালী নেতা এসে বললেন, গ্রামের নির্দিষ্ট কবরে অহিদকে দাফন করা যাবে না। লাশ নিয়ে যাওয়া যাবে না তাদের স্বাভাবিক চলাচলের পথ দিয়ে। অহিদের বাবার খোঁজ করলাম। তিনি বাড়িতে আছেন কিন্তু নিরাপদে বাসায়! শুনেছিলাম, ‘পিতার কাঁদে নাকি সন্তানের লাশ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী!’ সে ভার অহিদের বাবা কেন নিতে চাইলেন না, জানি না! ভাবলে চোখে পানি চলে আসে।
তিনি আরও, বলেন, আমরা অহিদের গোসল দিলাম। জানাজা পড়ালাম। নেতার হুমকির কারণে অহিদের লাশ নিয়ে চললাম কৃষি জমি হয়ে কখনও কাঁদা পানি, কখনও প্রায় হাটু পানির পথে, পুকুর পাড় বেয়ে, কখনও বাঁশমুড়ার সরু পথ মাড়িয়ে। অহিদের নিথর দেহ নিয়ে চলছি আমরা! ছাত্রলীগের ভাইয়েরা কেউ জিকির করছে, কেউ আমার মতো স্তব্ধ। অহিদের লাশের পালকি আমাদের কাঁধে। ঠোঁট ফেঁটে চিৎকার বের হচ্ছে না! দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। মনে মনে বলছি, অহিদ আমাদের ক্ষমা করিস ভাই! তার দাফন করেছি মোবাইল ফোনের টর্চের আলোয়।
তিনি বলেন,এই পর্যন্ত সাতজনের লাশ দাফন করেছি। স্বজনরা আসুক না আসুক আল্লাহ সুস্থ রাখলে আমাদের এই যুদ্ধ চলবে।
নগরীর রেইসকোর্স এলাকার কাউন্সিলর সরকার মাহমুদ জাবেদ বলেন, তার স্ত্রী আমাকে ফোন করেছিলেন। আগে ফোন করলে তার নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতাম। কাল তার স্ত্রী-সন্তানদের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।