পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের গোলরক্ষক ছিলেন রণজিৎ দাস। ১৯৫৫ সালে ইস্পাহানি ক্লাব দিয়ে ঢাকার শীর্ষ ফুটবল দলে অভিষেক হয়েছিল। এরপর খেলেছেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডানে। আজাদ স্পোর্টিং ঢাকা লিগে একবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন দলের অধিনায়ক ছিলেন এই রণজিৎ দাস। মোহামেডানের হয়ে একই বছর জিতেছিল লিগ ও আগাখান গোল্ডকাপ। পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল ও হকি দলের গোলকিপার হিসেবেও নজর কাড়েন তিনি। তিনি দক্ষ খেলোয়াড়ের পাশাপাশি একজন দক্ষ প্রশিক্ষকও ছিলেন। তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে সিলেটের অনেক খেলোয়াড়।
২৯ অক্টোবর ১৯৩২ সালে কমলা কান্ত দাস ও বাসন্তীলতা দাসের সংসার আলো করে এসেছিলো তাঁদের পঞ্চম ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। তখন নাম রাখা হল রণজিৎ, যার অর্থ যুদ্ধে যে জয়ী হয়। একবার সংবাদ মাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, তিনি ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন চল্লিশের শেষ দিকে। তখন স্টেডিয়াম ছিল না। সে সময় তারা আলিয়া মাদ্রাসা আর এমসি কলেজ মাঠে খেলতেন। ১৯৫৫-১৬৬০ পর্যন্ত টানা এক নম্বর গোলরক্ষক হিসেবে খেলছিলেন পূর্ব পাকিস্তান দলে। সে সময় অবশ্য তিনি সিলেটে কমই থাকতেন। ঢাকায় খেলতেন আজাদ, মোহামেডানসহ অনেক দলে।
ফুটবলের হাতেখড়ি বাবার কাছে
রণজিৎ দাসের কন্যা রিমা দাসের এক লেখায় জানা যায়, ছোট থেকেই রণজিৎ দাস বাবার সান্নিধ্যে খেলায় মনোনিবেশ করেন। ৩০ এর দশকে বাবা অবসর গ্রহন করায় তাঁরা সপরিবারে কলকাতা থেকে তাদের মূল বাড়ি সিলেটে চলে আসেন। এখানে তাঁর বাবার হাটার সঙ্গী ছিলেন তিনি। ১৯৩৯ এর এপ্রিল মাসের কোনো এক বিকেলে পিতা ও পুত্র যখন হাঁটতে বের হলেন তখন টাউন মাঠে (বর্তমান শহীদ মিনার ও সদর হাসপাতাল) অনেক লোকের ভীড় দেখলেন। রণজিৎ দাসের প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হল। তিনি পিতার কাছে জানতে চাইলেন—‘কি হচ্ছে সেখানে?’
তাঁর পিতা জানালেন, ফুটবল খেলা হচ্ছে। সেটা শুনে পিতার কাছে আবদার—‘আমিও খেলা দেখব’। পিতা সেই আবদার রেখেছিলেন। তাঁরা প্রায় ১৫/২০ মিনিট খেলা দেখেছেন আর হাজারো প্রশ্ন করেছিলেন পিতাকে। তাঁর পিতাও বন্ধুর মত সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। পুত্রের এতো আগ্রহ দেখে পিতা সে রাতেই স্লেট নিয়ে ফুটবল খেলার মাঠ একে দেখালেন, শিখিয়ে দিলেন কোন স্থানে কে দাঁড়াবে, কাকে কি বলা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এভাবেই খেলোয়াড় জীবনের হাতেখড়ি রণজিতের। ১৯৩৯-৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি দর্শক হয়ে বিভিন্ন খেলা উপভোগ করেন।
গোলকিপার হওয়ার পেছনের গল্প
রণজিৎ দাসের উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এই উচ্চতা নিয়ে এত ভালো গোলরক্ষক কীভাবে হয়েছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে মিডিয়াকে তিনি বলেছিলেন, গোলকিপার হওয়ার পেছনে একটা গল্প আছে। আমাকে গোলকিপার বানিয়েছে কায়সার হামিদের বাবা প্রয়াত (কর্নেল) এম এ হামিদ। সে ছিল সিলেটে আমাদের এইডেড স্কুলের ফুটবল ক্যাপ্টেন। সে-ই একদিন একটা ম্যাচে আমাকে গোলকিপিং করতে বলল। সেটা করতে গিয়ে দল হারল। আমি তাকে ‘সরি’ বলেছিলাম…। কিন্তু ও বলল, ‘ঠিক আছে, চালিয়ে যাও। ’ আরো অনেকে উৎসাহ দিল বলেই গোলকিপিং জারি রাখলাম। পরে কঠোর পরিশ্রম করেছি।
এখন স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন
সেই রণজিৎ দাসের বয়স এখন ৯০। থাকেন সিলেট শহরের করেরপাড়া পাঠানটুলায়। চারতলা বাড়ির দোতলায় তিনি থাকেন। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় স্মৃতিশক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন অনেকটা। পরিচিত মানুষকেও তিনি এখন চিনতে পারেন না। তবে পরিবারের সদস্যদের চেনেন তিনি। তাঁর সন্তান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়। আরেক ছেলে রাজীব দাস। আছে নাতি-নাতনি; তারাই এখন তাঁর জীবনের সঙ্গী। বিছানাবন্দী জীবনে সারা দিনই চুপচাপ থাকেন তিনি। কখনো কখনো নাতি-নাতনিদের ডাকেন। তবে বেশির ভাগ সময়ই কম পরিচিত লোকজনকে চিনতে পারেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন। আর নিজের মতো করে প্রশ্ন করেন।
অসুস্থ হওয়ায় গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল রণজিৎ দাসকে। কথা বলতে পারতেন না তখন। তখন কিডনি জটিলতা থেকে নিউমোনিয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। রণজিৎ দাসের ছেলে রাজীব দাস জানান, এখনো অনেক স্মৃতি আওড়ান তিনি। ওই সময়ে সেসব স্মৃতি তাঁর মনে পড়ে এখনো। তবে আগের মতো আর গল্পে মেতে উঠতে পারেন না।