প্রত্যেক ঈমানদারের কর্তব্য হলো প্রথমত নিজের জীবনকে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত করা। কিন্তু পরকালে মুক্তির জন্য এটাই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে নিজের পরিবার, সমাজ ও প্রতিবেশীদের হিদায়াতের পথে পরিচালিত করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষত নিজের পরিবার ও অধীন লোকেরা যাতে জান্নাতের পথে চলতে পারে, পরিবার প্রধানের উচিত সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো (জাহান্নামের) আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। ’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)
রমজানের মাহাত্ম্য অর্জনে ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি পারিবারিক পরিমণ্ডলেও পবিত্র আবহ সৃষ্টি করা আবশ্যক। রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারকে তাহাজ্জুদে উদ্বুদ্ধ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশক এলে রাসুল (সা.) কোমর শক্ত করে বেঁধে নিতেন, রাত জেগে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৪)
তাই প্রত্যেক মা-বাবার দায়িত্ব হলো সন্তানকে পর্যাপ্ত ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া। পাশাপাশি আমল ও ইবাদতের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে তোলা। মহান আল্লাহ ইবাদতের ওপর সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্ব মা-বাবার ওপর অর্পণ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকে নামাজ-রোজায় অভ্যস্ত করাতেন, যেন তারা এ মহান ইবাদত পালনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সন্তানকে উত্তম গুণাবলি ও ভালো কাজে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য মহানবী (সা.) বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। নামাজ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজ আদায়ের আদেশ করো। এ ব্যাপারে অবহেলা করলে ১০ বছর বয়সে তাদের প্রহার করো এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)
নারী ও পরিবারের ছোট-বড় সদস্যদের রমজানে ইবাদতের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) উদ্বুদ্ধ করতেন। আবু জর (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে রোজা রেখেছি। তিনি আমাদের সঙ্গে নামাজ আদায় করেননি। মাসে আর সাত দিন অবশিষ্ট। অতঃপর তিনি আমাদের নিয়ে রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর ষষ্ঠ দিনও আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করেননি। অতঃপর পঞ্চম দিন আবার আমাদের নিয়ে রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত নামাজ আদায় করেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাদের জন্য বাকি রাত নফল করে দিন। তিনি বলেন, যে ইমামের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত নামাজ পড়বে সে পুরো রাত নামাজ আদায়ের সওয়াব পাবে। অতঃপর তিনি আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন না। মাসের আর তিন দিন অবশিষ্ট। তৃতীয় দিন তিনি আমাদের নিয়ে নামাজ পড়লেন। তখন তাঁর পরিবার ও স্ত্রীদেরও ডাকলেন। আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করলেন। আমরা সাহরির সময় শেষ হওয়ার আশঙ্কা করলাম। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৮০৬)
শিশুদের রোজার অভ্যাস গড়ে তোলার ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে : রুবাই বিনতে মুআব্বিজ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আশুরার সকালে আল্লাহর রাসুল (সা.) আনসারদের সব পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেন, যে ব্যক্তি সাওম পালন করেনি সে যেন দিনের বাকি অংশ না খেয়ে থাকে, আর যার সাওম অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন সওম পূর্ণ করে। রুবায়্যি (রা.) বলেন, পরবর্তী সময় আমরা ওই দিন সাওম পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের সাওম পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ওই খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত। (বুখারি, হাদিস : ১৯৬০)
ইমাম বুখারি (রহ.) সহিহ বুখারি শরিফে একটি অনুচ্ছেদের নামকরণ করেছেন-‘সাওমুস সিবয়ান’ বা শিশুদের রোজা। এ অনুচ্ছেদের অধীনে তিনি ওমর (রা.)-এর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ওমর (রা.) রমজান মাসে এক নেশাগ্রস্ত লোককে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য আফসোস! আমাদের ছোট শিশুরা পর্যন্ত রোজাদার! (অথচ তুমি রোজা রাখো না)। ’ এরপর ওমর (রা.) তাকে প্রহার করেন। এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি (রহ.) লিখেছেন, ইবনে সিরিন, ইমাম জুহুরি ও ইমাম শাফেয়ি (রহ.)সহ পূর্ববর্তী বহু মনীষী শিশুদের রোজায় অভ্যস্ত করানোকে মুস্তাহাব ইবাদত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতে, নামাজের মতো সাত থেকে ১০ বছরের শিশুদের রোজায় অভ্যস্ত করানো যায়। (ফাতহুল বারি : ৫/৩)
আলেমদের কেউ কেউ এ সময়কে ১০ বছর বয়স থেকে নির্ধারণ করেছেন। তবে এর কম বয়সী বা একেবারে ছোট শিশুদের রোজা রাখানো উচিত নয়। কেননা একেবারে ছোট শিশুরা ইসলামের বিধি-বিধানের আওতাধীন নয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিন ধরনের লোকের ওপর থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে (ইসলামের বিধান স্থগিত করা হয়েছে)। (১) পাগল, যতক্ষণ না সুস্থ হয় (২) নিদ্রিত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয় এবং (৩) নাবালগ শিশু, যতক্ষণ না বালেগ হয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৩৯৯)
তবে সময় ভেঙে ভেঙেও শিশুদের রোজা রাখানো যায়। যেমন- প্রথমে কিছুদিন ঠিক দুপুরে পানাহার, পরে মাগরিবের সময় ইফতার। এভাবে শিশুরা রোজা পালনে অভ্যস্ত হয়।
মনে রাখতে হবে, রোজা রেখে কোনো শিশু যদি একেবারে কাতর বা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে দেরি না করে তার রোজা ভেঙে ফেলাও বৈধ। কেননা মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হাতে নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কোরো না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)