‘গত ১৫দিন থাকি বানের পানিত ভাইসপার নাগছি । আল্লাহ চালবের নাগছে। একবেলা খাই একবেলা উপোস করি থাকি। তিনটা ছোট ছাওয়াক নিয়া বিপদে আছি। ওমরা তো অভাব বোঝে না। খালি খাবার চায়। কিন্তু ঘরত তো খাওয়ার যোগার নাই। আইজ সকালে ছওয়া তিনকোনা এক পোয়া পন্তা ভাগ করি খাইছে। হামরা দু’জন এক মুট চিড়া চাবায়া আছি। দুপরে খাবার জইন্তে এক কেজি চাউল ধার করি আনছি বিকালোত আছরের আজান দিলে রাধমো। একমুট ডাইলও আছে। উইয়াকে দিয়া ৫জনে ভাগ করি খামো। বাকিটা ফির রাইতের জন্য আখমো। কাইল কি হইবে তাক কবার পারার নই। ’ তিন মাসের গর্ভবতী আনিছা বেগম তার দুর্দশার কথা এভাবে ব্যক্ত করলেন। উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপূত্র নদের পেটে অবস্থিত বাবুর চর।
এখানকার কৃষি শ্রমিক সাইফুলের স্ত্রী আনিছা। দুই মেয়ে এক ছেলে। সাথী আক্তার (১০), সুমী (৫) এবং রাশেদুল (২)। এরপর আবার তিনি ৩ মাসের অন্তঃস্বত্বা। নেই পুষ্টি কিংবা স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ। সাইফুল জানান, বন্যা শুরু হইছে থাকি হাতোত কোনো কাজকাম নাই। সঞ্চয় যা করছিলং তাও শ্যাষ। এ্যালা ধারকর্জ করি কোনোরকমে চলবের নাগছি। ছওয়াপোয়াক নিয়া নিজেরাই খাবার পাং না। বউয়োক ভালোমন্দ খাওয়ামো কি।
তিনি দুঃখ করে বললেন, চেয়ারম্যান-মেম্বার কাঁইয়ো খোঁজ নেয় নাই। কোন ইলিপ দেয় নাই। বিষদবার কয়েখজন ছাত্র আসি এক কেজি চিড়া এবং এক পোয়া গুড় দিছে।
গত দু সপ্তাহের খাদ্য তালিকায় কি ছিলো এমন প্রশ্নের উত্তরে আনিছা জানান, একদিন মাছ খাইছি। আর বাড়ির মুরগীর ডিম চারদিন। মাংস কিংবা দুধ জোটেনি। শুধু ভাত, পাট শাক, ডাল আর লবণ মরিচ। এরকম অবস্থা এই বাবুর চরের ৯টি পরিবারের। পরিবারগুলো হলো- শাহের আলী, ছক্কু মিয়া, সাইফুল, কবির উদ্দিন, আতাউর, আলম, তাইজুল, ফারুক এবং বক্করের পরিবারের হালহকিকত। তাদের ভাগ্যে সরকারি কোন ত্রাণ পৌঁছেনি গত ১৫দিনেও। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে ত্রাণের কোনো অভাব নেই।
শুক্রবার দূর্গম বাবুর চরে সরেজমিন গেলে স্থানীয়রা কোমড় পানি ভেঙ্গে আমাদের নৌকাটিকে ঘিরে ধরে শিশু নারীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। তাদের আকুতি ‘হামার গুলার কথা একনা লেখেন বাহে। ছাওয়া-পোয়া গুলাক নিয়া খুব কষ্টোত আছি। খাবার নাই। পানির কষ্ট। ছইল-পইল মানুষ না খায়া থাইকপার পায় না। হামরা গুলা না হয় একবেলা খায়া থাকলোং। ’
কৃষ্ণা বালা বলেন, নিজেরে খাবার নাই এলা ছাগল আর মুরগীক কি খাওয়াই। মহাবিপদ হইছে। তাই ছাগলের জন্য পাটের পাতা ছিড়ি আনলোং। উয়াকে হামরাও খামো আর ছাগলও খাইবে। সম্বরি বেওয়া বলেন, ‘সকাল থেকে কিছু খাই নাই। আধা কেজি চাউল আছে বিকালে রাধমো। সাথে কলাগাছের মাজা সিদ্ধ করি খামো। তাকে দিয়া রাইতোতও চলবে। ’
নদীর মাঝেখানে এক ব্যক্তি নৌকায় ৫/৬টি ছাগল নিয়ে পাটখেতের ভিতরে ভিতরে যাচ্ছেন আর ছাগল মুখ বাড়িয়ে পাটের পাতা খাচ্ছে। মালিক শহিদুল বলেন, নিজেদের খাবার জোটে না, ছাগল গুলাক বাচাই কেমনে। কোনঠেও ঘাস নাই। নিরুপায় হয়া পাট ক্ষ্যাতোত নৌকাত করি খোবার নাগছি।
হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হোসেন বলেন, অপ্রতুল ত্রাণ সহায়তার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আর দূর্গম চরাঞ্চলের অবস্থা খুবই খারাপ।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে যাওয়ায় কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে চর ও নদ-নদীর অববাহিকার নিচু এলাকাগুলোতে এখনও পানি জমে আছে। পানিবন্দী রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। অনেকের ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও সেগুলো বসবাসের উপযোগী হয়নি।
এদিকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতের চিহ্ন দৃশ্যমান হচ্ছে। চরের রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় যাতায়াতের ভোগান্তি কমেনি।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জের চর বাগুয়ার চরের বাসিন্দা মুসা মিয়া জানান, গ্রামের অধিকাংশ লোকের ঘর থেকে পানি নামলেও আঙিনা ও বাড়ির চারপাশে পানি জমে আছে। এই গ্রামের কৃষক মাইদুল ইসলাম, তৈয়ব আলী ও সিদ্দিক মেম্বার জানান, বন্যার পানিতে পাট ক্ষেত ডুবে ছিল। এখন পানি কমে যাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে বালু পড়ে পাটক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সন্ন্যাসী গস্খামের কৃষক আব্দুল কাদের জানান, সারডোবের চরে আবাদ করা তার পাট ও বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। হাতে টাকা পয়সাও নেই। এখন সরকারি সহায়তা ছাড়া নতুন করে আবাদ করা সম্ভব হবে না।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন, বন্যায় জেলায় ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় ৭ হাজার কৃষককে বীজ ও সার দিয়ে সহায়তা দেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, চলতি বন্যায় প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত ৫৩৮ মেটিকটন চাল, ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার উপ-বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ত্রাণ কার্যক্রম চলমান আছে।