নামাজে দাঁড়ালে অনেক সময় এলোমেলো চিন্তাভাবনা আসে। নানা কিছু মনে পড়ে। মাঝেমধ্যে নামাজের রাকাত সংখ্যায় ভুল হয়ে যায়। অনেকেই নামাজে মনোযোগহীনতায় আক্রান্ত। এক হাদিসে রাসুল (সা.) এটিকে ‘শয়তানের ছিনতাই’ বলেছেন।
এ ব্যাপারে ইমাম আবু হামিদ আল-গাজ্জালি (রহ.) তার বিখ্যাত ‘ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এতে তিনি ছয়টি বিষয়ের কথা বর্ণনা করেন, যেগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিলে নামাজে মনোযোগ ধরে রাখা যায়।
১. নামাজে ‘হুজুরে দিল’ বা একাগ্র থাকা; এটি নামাজের প্রাণ। এমনভাবে নামাজ পড়তে হবে যেন আল্লাহ আমাকে দেখছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো এমনভাবে যেন তাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখছেন। ’ (সহিহ বুখারি : ৫০, সহিহ মুসলিম : ৮)
নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই কল্পনা ধরে রাখার অনুশীলন করুন যে ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’। এভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে নামাজ শেষ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে সুন্দরভাবে অজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে একাগ্রতার সঙ্গে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে (অন্য বর্ণনায় এসেছে- যে নামাজে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না), তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায় (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়)। ’ (সহিহ বুখারি : ১৯৩৪, নাসাঈ : ১৫১)
২. নামাজে যা কিছু তেলাওয়াত করা হয় তা বিশুদ্ধ উচ্চারণে পড়ার চেষ্টা করুন। এটি অন্তরের উপস্থিতিকে আরও দৃঢ় করে। অন্তত সুরা ফাতিহা ও তাসবিহগুলোর অর্থ বুঝে পড়ার চেষ্টা করুন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত করো। ’ (সুরা মুজ্জাম্মিল : ৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতিটি সুরা তারতিলসহকারে তেলাওয়াত করতেন। (সহিহ মুসলিম : ৭৩৩, তিরমিজি : ৩৭৩)
৩. নামাজে আল্লাহর প্রতি ‘তাজিম’ বা ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করুন। কেননা আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হও বিনীতভাবে। ’ (সুরা বাকারা : ২৩৮) কাজেই ধীরস্থিরতা অবলম্বন করুন। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিকৃষ্টতম চোর হলো সেই ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। ’ জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজে কীভাবে চুরি করে? তিনি বলেন, ‘যে রুকু-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না। ’ (মুসনাদ আহমাদ, মিশকাত : ৮৮৫)
৪. নামাজে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহকে ভয় করুন। ভাবুন, এই নামাজই হয়তো আপনার জীবনের শেষ নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জনৈক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করলে তিনি তাকে
বলেন, ‘যখন তুমি নামাজে দণ্ডায়মান হবে তখন এমনভাবে নামাজ আদায় করো, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ নামাজ। ’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত : ৫২২৬)
৫. নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কল্যাণ আশা করুন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। ’ (সুরা : বাকারা : ৪৫) এই বিশ্বাস রাখুন, আল্লাহ আমার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ালে সে মূলত তার প্রভুর সঙ্গে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে, কীভাবে সে কথোপকথন করছে। ’ (মুসতাদরাক হাকেম, সহিহুল জামে হাদিস : ১৫৩৮)
৬. নামাজে নিজের গুনাহর কথা চিন্তা করে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হওয়ার কথা ভেবে নিজের মাঝে ‘হায়া’ বা লজ্জা নিয়ে আসুন। দণ্ডায়মান অবস্থায় একজন অপরাধীর মতো মস্তক অবনত রেখে এবং দৃষ্টিকে সিজদার স্থানের দিকে নিবদ্ধ রাখুন। রাসুলুল্লাহ (সা.) (দাঁড়ানো অবস্থায়) সিজদার জায়গায় দৃষ্টি রাখতেন। (তাফসিরে তবারি : ৯/১৯৭)
উপরের ছয়টি বিষয় অনুসরণ করলে নামাজে মনোযোগ তৈরি হবে, ইনশাআল্লাহ। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজের সময় হলে সুন্দরভাবে অজু করে এবং একাগ্রতার সঙ্গে সুন্দরভাবে রুকু-সিজদা করে নামাজ আদায় করে, তার এ নামাজ আগের সব গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়। আর এ সুযোগ তার সারাজীবনের জন্য। ’ (সহিহ মুসলিম : ২২৮)