প্রায় কোটি টাকা মূল্যের জাল নোটসহ জাল টাকা তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মো. মাউন হোসেন সাব্বির (২১) ও তার চার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৪। শনিবার (২২ অক্টোবর) রাতে রাজধানী ঢাকার চকবাজার, সিরাজগঞ্জ এবং খুলনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে জাল নোট তৈরির সরঞ্জামাদিও উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন- মো. পারভেজ (২০), মো. তারেক (২০) ও মো. শিহাব উদ্দিন (২০)।
আজ রবিবার (২৩ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব জানতে পারে, একটি চক্র প্রায় এক বছর যাবৎ জাল নোটের ব্যবসা করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে চক্রটিকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর অভিযানকারী দল রাজধানীর চকবাজার থানার মিটফোর্ড এলাকা, সিরাজগঞ্জ সদর এবং খুলনা জেলার খালিশপুর থানা এলাকায় পৃথক অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ জাল নোট তৈরি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এ সময় গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের নিকট হতে প্রায় এক কোটি টাকার সমমূল্যের জাল নোট; একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার, একটি পেনড্রাইভ, অ্যান্টি কাটার একটি, টাকার পাঞ্চিং এক রোল, জিলেটিং ৫০০ গ্রাম, প্রিন্টারে ব্যবহৃত কালির খালি বোতল ১২টি, গালা ৫০০ গ্রাম, স্পিরিট ০৬ বোতল, ফেবিকল আঠা ০৬ বোতলসহ জালনোট তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জাল নোট তৈরি ও বিক্রয় সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, তারা পরস্পর যোগসাজশে প্রায় এক বছর যাবৎ ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করত। এ ছাড়া এ চক্রের সদস্যরা নিজেরাও বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং দোকান, মাছের আড়তের জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় জাল নোট ব্যবহার করত। এ চক্রটির অন্যতম হোতা গ্রেপ্তারকৃত মাউন হোসেন সাব্বির এবং এই চক্রের সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়। তারা কম
সময়ে অল্প পুঁজিতে ধনী হওয়ার জন্য এই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, ইউটিউব এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এই ধরনের জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসার প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়। চক্রের অন্যতম হোতা সাব্বির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজে পরিচালিত একটি গ্রুপ ‘‘জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোস্ট’’ এর মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত অপর সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সে জাল নোটের খুচরা ব্যবসা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অপর একটি জাল নোট তৈরি চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। চক্রটির নিকট হতে সে তিন লক্ষ টাকার জাল নোট ক্রয়ের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে ৩৫ হাজার টাকা প্রেরণ করে। জাল নোট ক্রয়ের জন্য সে অর্থ প্রদান করলেও চক্রটি তাকে কোন জাল নোট প্রদান করেনি। চক্রটির নিকট হতে সে জাল নোট না পেয়ে নিজেই জাল নোট তৈরির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রথমে মেসেঞ্জার এ X-MAN নামে একটি গ্রুপ খুলে জাল
টাকা তৈরি-ব্যবসার বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করে। এই গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে শিহাব কাজ করত। শিহাবের মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত অপর দুই সদস্য পারভেজ এবং তারেক এর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সে ইউটিউব, ফেসবুক এবং গুগল ঘেঁটে জাল নোট তৈরির বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করে এবং বিভিন্ন সময়ে জমানো অর্থ দিয়ে জাল নোট তৈরির জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার, প্রিন্টিং ডাইস, পেনড্রাইভ, কাগজ, টিস্যু পেপার ও প্রিন্টারের কালিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয় করত। গ্রেপ্তারকৃত সাব্বির জালনোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় সবকিছু সে নিজেই পরিচালনা করত। যখন জাল নোটের ব্যবসা রমরমা থাকে তখন চক্রটি দৈনিক ২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যমানের জাল নোট তৈরি করত। মূলত তারা একটি অভিনব কায়দায় জাল নোটগুলো বিক্রয় করত। তারা তাদের পূর্বের ফেসবুক গ্রুপ ‘‘জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোস্ট’’ থেকে কমেন্টস দেখে তাদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে চ্যাটিং এর মাধ্যমে ক্লায়েন্ট তৈরি করে জাল টাকার ব্যবসা করত। পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চক্রের সদস্যেদের মাধ্যমে ঢাকাসহ সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর এলাকায় সরবরাহ করত। তারা কখনো সরাসরি জাল নোটগুলো ক্লাইন্টকে দেখাত না। গ্রুপ থেকে ক্লায়েন্টদের সিলেক্ট করে তাদের সঙ্গে মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে কথাবার্তা বলে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিত। তারা প্রতি ০১ লক্ষ টাকা মূল্যের জাল নোট ১৫-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত। চক্রটি মূলত জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত করণের জন্য ঢাকাকে নিরাপদ ও সহজ স্থান বলে মনে করত। চক্রটি সাধারণত বিভিন্ন মেলা, উৎসব, পূজা, ঈদে পশুর হাটে ও অধিক জন-সমাগম অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জাল নোট ব্যবহার করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জালনোট প্রিন্টিং এর সময় কাগজেরঅব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয়ে ফেলত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে তাদের কাজ পরিচালনা করত। এ পর্যন্ত চক্রটি বিভিন্ন সময়ে প্রায় ০২ কোটি মূল্যমানের জাল নোটের ব্যবসা করেছে বলে জানা যায়। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।