১৯৯৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তখন রাত ১১টা। মোস্তাফিজুর রহমান বাহাদুরের বয়স তখন ৬ বছর। ওই সময় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে বাহাদুরের চোখের সামনেই খুন হন বাবা সুলতান উদ্দিন। এই হত্যায় করা হয় মামলা।
চলে বিচারকার্য। আর বড় হতে থাকেন চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে দেখা বাহাদুরও। বাবা হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হয়েছেন আইনজীবী। আইন পেশায় এসেই কাঁধে নেন বাবা হত্যার মামলার দায়িত্ব।
অবশেষে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে ২৯ বছর পর সোমবার সেই হত্যা মামলার রায় হয়েছে। রায়ে নিহতের দুই ভাইকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অপর এক ভাইসহ পাঁচজনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২ এর বিচারক বাহাউদ্দিন কাজী এ রায় ঘোষণা করেছেন।
রায়ে আমৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার বেড়াইদেরচালা এলাকার ধনাই বেপারীর ছেলে ও নিহতের ভাই মাইন উদ্দিন বেপারী এবং সৎ ভাই আবুল কাসেম বেপারী। যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলেন- নিহতের ভাই আবদুল মান্নান, একই এলাকার সিরাজ উদ্দিন, শুক্কুর আলীর ছেলে আজিজুল হক ও আবদুল কাদিরের ছেলে দুলাল উদ্দিন ও বেলতলী এলাকার সোনা উল্লাহর ছেলে মাঈন উদ্দিন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় স্থানীয় গিয়াস উদ্দিনকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
মামলার আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান বাহাদুর বলেন, বাবার সঙ্গে তার ভাইদের জমি-সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছিল। ১৯৯৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে বসতঘরে বসে ভাই মোতাহার হোসেন ও প্রতিবেশী মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করছিলেন বাবা। এ সময় দরজা খোলা থাকায় জমি বিরোধের জেরে আসামিরা আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রসহ ঘরে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করেন। একপর্যায়ে তারা বাবাকে বুকে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান বাবা।
তিনি বলেন, চিৎকার শুনে বাবাকে রক্ষা করতে গেলে আমার দুই ভাই মোবারক হোসেন ও আবুল কালাম আজাদ এগিয়ে গেলে তাদেরও জখম করে হামলাকারীরা। পরে তাদের চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে হামলাকারীরা গুলি করতে করতে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। রোমহর্ষক এ হত্যাকাণ্ডের ১৫ দিন আগেও আসামিদের কয়েকজন সুলতান উদ্দিনকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এ কারণে ১৯৯৩ সালের ৩১ আগস্ট শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়।
এই আইনজীবী আরো বলেন, এ ঘটনায় চাচা মোতাহার হোসেন বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ১৩ জনকে অভিযুক্ত করে ১৯৯৫ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ১৯৯৭ সালে গাজীপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার কাজ শুরু হয়। দীর্ঘদিন শুনানি ও ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে আদালত সোমবার এ রায় দেন। রায় ঘোষণাকালে আসামিরা আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। ২৯ বছরে মামলা চলাকালে অভিযুক্ত একই এলাকার ময়েজ উদ্দিন বেপারী, মোমেন, মোস্তফা, আব্দুল ওয়াহাব ও হানিফা মারা গেছেন।
মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন সুলতান উদ্দিন ও আব্দুর রশিদ।
নিহতের ছেলে ও মামলার আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান বাহাদুর রায় ঘোষণার পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমার বাবাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমার বয়স ছিল ৬ বছর। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে বড় হয়ে আইনজীবী হয়েছি। ২৯ বছর পর হলেও একজন সন্তান হিসেবে আমি আমার বাবা হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে পেরেছি, এটা আমার অনেক বড় পাওয়া।