পরীক্ষা শেষে বাড়িতে আসবেন বলে মাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন লিমন কুমার রায়। তিনি কিশোরগঞ্জের বাড়িতে ফিরেছেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের ১০ তলার ছাদ থেকে পড়ে মারা যাওয়া লিমনের মরদেহ তার গ্রামে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার(২৪নভেম্বর) রাত সোয়া ৮টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে লিমনের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়।
এর আগে বুধবার (২৩ নভেম্বর) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন লিমন। সকাল সাড়ে ১০টায় গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
লিমন কিশোরগঞ্জের মাগুরা ইউনিয়নের দোলাপাড়ার রিকশাচালক প্রভাষ চন্দ্র রায় ও নীলা রানী রায় দম্পতির ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (আইইআর) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন জগন্নাথ হলের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ভবনের একটি কক্ষে।
প্রভাষ চন্দ্র রায় ও নীলা রানী রায় দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে লিমন ছিলেন সবার বড়। সম্বল বলতে বাড়ির চার শতক জমি। প্রভাষ কখনো রিকশা চালিয়ে আবার কখনো কৃষিশ্রমিকের কাজ করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন।
নিহত লিমন ২০১৭ সালে মাগুড়া শিঙ্গের গাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে রংপুরের কারমাইকেল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাস করেন। দুই পরীক্ষাতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন তিনি। তার ছোট ভাই সুমন রায় দশম এবং সবার ছোট বোন অর্পিতা রায় পড়ছে পঞ্চম শ্রেণিতে। মা নীলা রানী রায় গৃহিণী।
লিমন সব সময় মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। করোনাকালে লকডাউনের সময় গ্রামের বাড়িতে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি পাঠশালা গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন।
লিমনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা নীলা রানী আঙিনায় গড়াগড়ি দিয়ে বিলাপ করছেন। তাকে সামলানোর চেষ্টা করছেন স্বজনেরা। আরেক দিকে বাবা আহাজারি করছেন। আত্মীয়-স্বজনও শোকে মুহ্যমান। তার মৃত্যুর খবরে তার বাড়িতে এসে ভিড় করেছেন প্রতিবেশীরা।
প্রতিবেশী ভুজঙ্গ চন্দ্র রায় বলেন, ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে ছেলেকে পড়াশোনা করাতেন বাবা প্রভাষ। মা-বাবার স্বপ্ন ছিল, অভাবের সংসারে সুখ আসবে ছেলের হাত ধরে। সেই ছেলেকে হারিয়ে সব স্বপ্ন যেন নিমেষেই শেষ হয়ে গেল তাদের। তার মৃত্যুর খবরে পরিবারটি যেমন নির্বাক, তেমনি গ্রামবাসীও হতবাক।
বাবা প্রভাষ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার লিমন এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না। এর পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে। সে থাকত জগন্নাথ হলে ষষ্ঠ তলায়, কিন্তু দশ তলায় সে কেন যাবে? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা হোক।
লিমনের স্কুলশিক্ষক মিথুন কুমার রায় বলেন, দরিদ্র বাবার সন্তান লিমন ছিল মেধাবী। সে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এলাকায় নম্র, ভদ্র ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে ওর পরিচিতি রয়েছে। ওর মৃত্যুতে পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
মাগুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকতারুজ্জামান মিঠু বলেন, লিমনের বাবা খুবই অসহায়, গরিব। রিকশা চালিয়ে তার লেখাপড়ার খরচ চালাতো। তাকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। সে লেখাপড়া শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। তার মধ্যে তো এই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। পরিবারটির পাশে আমি সবসময় আছি। পাশাপাশি সরকার এই অসহায় পরিবারটিকে যেন একটু দেখে।